আজকাল বাচ্চাদের পড়ালেখা নিয়ে বাবা-মায়েদের বাড়াবাড়ি দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বুঝতে পারছি না আমি আমার বাচ্চাদের নিয়ে কি করব! চারপাশে দেখছি সচেতন অভিভাবকগণ তাদের কচিকাঁচা সোনামণিদের লেখাপড়া নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। প্লে গ্রুপে পড়ুক আর যে গ্রুপেই পড়ুক গোল্ডেন এ+ দরকার।তোতাপাখির মতো মুখস্হ করে লিখুক, দেখে দেখে লিখুক কিংবা প্রশ্নপত্র আউট করে নকল করেই লিখুক গোল্ডেন এ+ চাই-ই চাই। চারদিকে আজ গোল্ডেন এ+ পাবার হাহাকার। প্রয়োজন নেই মানুষ হবার!
আমি একজন শিক্ষক, অভিভাবকও। খুব কাছ থেকে দেখছি শিশুদের দারুণ সকরুণ মুখ।তাদের মাঝে আজ বাল্যকালের স্বাভাবিক গতি নেই। নেই প্রাণচাঞ্চল্যতা।
তারা আজ ফুল-পাখিদের ডাকে সাড়া দিতে জানে না। পুকুরে সাঁতার কাটতে জানে না। প্রাণখুলে হাসতেও জানে না। তাদের চোখে-মুখে আজ গোল্ডেন এ+ এর বিবর্ণ ছাপ।
অভিভাবকগণের আর একটি কঠিন স্বপ্ন তাদের পোষ্যকে নামি-দামি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো। এ আরেক নিঠুর খেলা! স্বাভাবিক পড়ালেখা বাদ দিয়ে কিছু মানিমেকার অবিবেচক রোবটিক কোচিং শিক্ষকদের দুয়ারে ধর্ণা দেন তারা দিনের পর দিন। হাঁটতে শেখা শিশুকে ঠেলে দেন জীবনের কঠিনতম যুদ্ধে। ভর্তি হতে পারলে সে কি রাজ্যজয়ের আনন্দ! আর না পারলে রাজ্য হারানোর চরম বিষাদ! জিতুক বা হারুক সে তার স্বাভাবিক ধারা হারিয়ে ফেলে। এমনও দেখেছি কোন কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠান প্রধান, শিক্ষক কিংবা কর্মকর্তা-কর্মচারী সন্তানকে তার প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অধিকতর নামি-দামি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে পারলে নিজেদেরকে খুব বেশি ধন্য মনে করেন!
কোমলমতি শিশুদেরকে নিষ্পেষিত করার আরেকটি প্রক্রিয়া তথাকথিত মেধাবৃত্তি। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠেছে এসব মেধাবৃত্তি প্রকল্পগুলো।বাহারি নামে আর ছটকদার সব বিজ্ঞাপনে ঢাকঢোল পিঠিয়ে চলছে মেধাবৃত্তি প্রদান নামক অভিনব ব্যবসা। এক শ্রেণির অতি উৎসাহি অভিভাবক এসব টোপ গিলছেন আর তার প্রিয় সন্তানটিকে ঠেলে দিচ্ছেন চরম ভুল পথে।মনে রাখতে হবে চারদিকে নিজের শিশুটিকে জাহির করতে যাওয়া মানে শিশুটিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়া।কিন্তু কে শুনে এসব নিরস কথা!
হায়রে আধুনিক শিক্ষা তুমি আজ বড়ই পু্ঁজিবাদী। অভিভাবকগণ আজ তোমার কেনা গোলাম।
শিশুরা তোমার চাপে নির্যাতিত, নিপীড়িত!
ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠা শিশুদের অধিকার। গোল্ডেন এ+, ভর্তি পরীক্ষার মল্লযুদ্ধ কিংবা তথাকথিত মেধাবৃত্তি তাদের সাথে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।সময় এসেছে শিশুদের শিক্ষালাভের প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবার। সময় এসেছে ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবার।এসব ভর্তিযুদ্ধ স্কুল পর্যায়ে থাকা উচিত নয়। ঐসব নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচিত লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদেরও ভর্তি করিয়ে ইতিবাচক ফলাফল করে দেখানো। তেলের মাথায় তেল তো সবাই ঢালতে জানে।বেছে বেছে সেরাদের সেরা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়ে সেরা রেজাল্ট করে এসব নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আত্নগৌরবের কিছুই দেখছি না।পারলে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদেরকে নিয়েও ইতিবাচক কাজ করে দেখাক। বলা যাবে তখন আসলে কারা সেরা।
সম্মানিত অভিভাবকগণের প্রতি করজোড়ে মিনতি- আপনারা কোমলমতি শিশুদেরকে নিয়ে জুয়া খেলবেন না।তাদের শিশুকালকে ফিকে করে দিবেন না।ওদেরকে বৃক্ষের মতো বেড়ে ওঠে ফুলে-ফলে সুশোভিত হতে দিন।ওদেরকে জীবনের স্বাভাবিক ধারায় চলতে দিন। আমরা যারা স্বাভাবিক ধারায় চলতে চাই তারাও আপনাদের অস্হিরতা দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি।শিশুরা বেড়ে উঠুক সহজ-স্বাভাবিক ধারায়।হয়ে উঠুক সত্যিকারের মানুষ।কবি কিশোর সুকান্তের কণ্ঠে কণ্ঠ রেখে বলতে চাই-
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
লেখক :শিক্ষক ও কবি
ctaj24.com/st