১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিং হত্যার পর দেশটিতে এত বড় বিক্ষোভ আর হয় নাই। বছর শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হেরে যাওয়ার এটিও অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন। বিক্ষোভ যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরেই ছড়িয়ে পড়ে তা নয়, আটলান্টিকের ওপারেও এর ঢেউ লাগে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের সমর্থনে বিক্ষোভ হয় বার্লিন, আমস্টার্ডাম ও লন্ডনেও। সবাই বর্ণবাদী হামলার শিকার সংখ্যালঘুদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। এসব ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদ কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল করে তুলেছে। বর্ণবাদ ইস্যুতে ইতিবাচক ভাবমূর্তি ছিল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটি শক্তিশালী ভিত্তি, সেটিও সমালোচনার মুখে পড়ে। নাগরিক অধিকার আন্দোলন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয় হলেও তা আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে ওঠে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজ প্রসঙ্গটি এলে সেখানে বর্ণবাদ একটি বিষয়।
বিদায়ি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন খোলাখুলিভাবে শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদ সমর্থন করেছে। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল সমাজে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাদাদের ক্ষমতা নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা। লক্ষণীয়, তার মন্ত্রীসভার সবাই শ্বেতাঙ্গ ও পুরুষ। সীমান্তে ল্যাটিনোদের গণহারে আটক করা হয়েছে। ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের অভিযান যেন ল্যাটিনোদের টার্গেট করেই পরিচালিত হয়। কথিত অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কেবল আইনগত প্রক্রিয়া গ্রহণ না করে তাদের উদ্দেশ্য করে চালানো হচ্ছে দমনাভিযান। সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা স্টিভ ব্যাননের কথামতো ট্রাম্প ডানপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে এতটা ঝুঁকে পড়েন যে, এর ফলে মিত্র দেশগুলোর সঙ্গেও তার প্রশাসনের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়। ট্রাম্প তার শাসনামলে ইউরোপের গণতান্ত্রিক মিত্র দেশগুলোর তুলনায় রাশিয়া ও হাঙ্গেরির প্রতি বেশি ঝুঁকেছেন।
বিগত কয়েক সপ্তাহের কর্মকাণ্ড দেখিয়ে দিয়েছে বর্ণবাদ ইস্যুতে পক্ষপাতমূলক দৃষ্টি পররাষ্ট্রনীতির কতটা ক্ষতি করেছে। বর্ণবাদ প্রশ্নে সহনশীলতা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম দিক। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই মার্কিনীদের একটি গর্বের বিষয়। যদিও দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বর্ণবাদ একটি বিতর্কিত ইস্যু হিসেবে দীর্ঘদিন বিরাজ করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র দুটি বর্ণবাদ সৃষ্ট যুদ্ধ খুব সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। একটি হলো দেশের ভেতরের সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধ (উনবিংশ শতাব্দীতে) এবং দ্বিতীয়টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (বিংশ শতাব্দীতে)। এই দুটি যুদ্ধে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মার্কিনী প্রাণ হারিয়েছে। এসব কারণে বর্ণবাদ বিরোধী ইমেজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গর্ব করার নৈতিক ভিত্তি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বর্ণবৈষম্য ও নিপীড়ক শাসকের দমন পীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মুক্তিকামী মানুষের প্রধান গন্তব্য। এই ইমেজ তৈরি হতে দেশটির দীর্ঘ সময় লেগেছে। শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ব ভাবধারা উত্থানে এখন মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সেই ইমেজে আঁচড় লেগেছে।
শক্তিশালী অর্থনীতি, জনসংখ্যার ঘনত্ব কম হওয়া এবং মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই অভিবাসীদের আকৃষ্ট করেছে। মূলত অর্থনৈতিক কারণেই অভিবাসীর প্রথম পছন্দের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ অভিবাসীরা। ইউরোপের অনেক দেশ বা জাপানের মতো জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটছে না যুক্তরাষ্ট্রে। ২০০৬ সালে দেশটি ৩০ কোটির মাইলফলক পার করে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫৮ সালে এই সংখ্যা ৪০ কোটি পৌঁছবে। জনসংখ্যা একটি দেশের অন্যতম চালিকা শক্তি। এদিক থেকে ভারত ও চীনের থেকে অনেক পিছিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। ঐ দুটো দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যা ২০০ কোটির ওপরে। অভিবাসন ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কোনো উপায় নেই। কারণ সেখানে মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার কম।
সি-তাজ.কম/হামিদ