বিদায় হে মহাকালের যাত্রী অধ্যক্ষ মুফতি আমিনুর রহমান ( রহঃ)। অধ্যক্ষ মুফতি আমিনুর রহমান ( রহঃ) এই জনপদের শুদ্ধস্বর ও শুদ্ধ বিবেকবানের আলোর পথিক হয়ে শিক্ষার ইতিহাসে বেঁচে থাকবেন পৃথিবী ধ্বংসাব্দী পর্যন্ত।এই ক্ষনের পৃথিবীতে আপনার আগমনের বাতি জালিয়ে আপনি বিদায় নিলেন চিরতরে। যে মহান আল্লাহ ও নবির বন্দনায় স্বরে স্বরে আপনি দাওয়াত ও শিক্ষাদিয়েছেন ; আজ তার সফলতার ইতিহাস মানুষ দেখতে পেয়েছেন ও জেনেছে।আপনার জানাজার নামাজ তার ই প্রমান মিলে। আপনার লেখনি জীবনে ৪০ এর অধিক মুল্যবান বই আপনার হয়ে অন্ধকারে ভরা জাতিকে আলোর পথ দেখাবে। আপনি মহান ও এ জাতির শিক্ষক। আমি ( সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র) ধন্য এ জীবনে আপনার সান্নিধ্য পেয়েছি। আপনার চলে যাওয়া বিদায় ক্ষনে মহান রবের দরবারে আপনার নাজাত কামনা করছি। একজন সাদা মনের মানুষ অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ আমিনুর রহমান। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ঐতিহ্যবাহী আলেম পরিবারে জন্ম তাঁর। তিনি একজন আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর। ১ মার্চ ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার মাওলানা মঞ্জিলের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুর রহমান (রহঃ)। তাঁর দাদার নাম অধ্যক্ষ মুফতি মাওলানা শফিউর রহমান ( রহঃ)। তার দাদা “মুফতি সাহেব” নামে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি নিজ এলাকা চন্দনাইশে হাশিমপুর মকবুলিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসা এবং জোয়ারা ইসলমিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় প্রতিষ্ঠায় ভুমিকা ও অধ্যক্ষ পদে ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সহিত দায়িত্ব পালন করেন। মাওলানা মুহাম্মদ আমিনুর রহমান তাঁর পিতার ৫ ছেলের মধ্যে ১ম পুত্র। তাঁর বংশ পরিক্রমা হল-মুহাম্মদ আমিনুর রহমান বিন মুহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বিন শফিউর রহমান বিন সৈয়্যদ হাসান মিয়াজি বিন নুরুদ্দীন।মাওলানা আমিনুর রহমান বাল্যকালে তাঁর দাদা মুফতি শফিউর রহমান (রহঃ) ও তাঁর পিতা মাওলানা মাহমুদুর রহমান (রহঃ) এর তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে দাখিল পরীক্ষায় ১ম বিভাগ সারা বাংলাদেশে ২য় হন। ১৯৭৯ সালে আলিম পরীক্ষায় ১ম বিভাগ সারা বাংলাদেশে ৩য়, ১৯৮১ সালে ফাজিল পরীক্ষায় ১ম বিভাগ সারা বাংলাদেশে ৫ম স্থান, ১৯৮৩ সালে মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকা হতে কামিল হাদীস পরীক্ষায় ১ম শ্রেণি ৩য় স্থান, ১৯৮৪ সালে মাদ্রাসা-ই-আলিয়া,ঢাকা হতে কামিল ফিকাহ পরীক্ষায় ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান , ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক বিভাগ হতে এম.এ ১ম পর্ব ১ম বিভাগ ১ম স্থান, ১৯৯০ সালে এম.এ ফাইনাল পরীক্ষায় ১ম বিভাগ ২য় কৃতিত্ব সহিত উত্তীর্ণ হন।মাওলানা আমিনুর রহমান ১৯৮৫ সালে উপাধ্যক্ষ ও ২০০২ সালে হতে মৃত্যুদিন পর্যন্ত অধ্যক্ষ পদে জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় সুনাম ও সুদক্ষ সহিত দায়িত্ব পালন করছেন।তিনি ০৭ মার্চ ১৯৯৫ জগৎবিখ্যাত আলেম অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ফখরুদ্দীন (রহঃ) (তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় সাবেক মুহাদ্দিস,সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় সাবেক অধ্যক্ষ,চুনতী হাকিমিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদীস পদে নিয়োজিত ছিলেন।) এর বড় মেয়ে মোছাম্মৎ নুরুন নাহার পারভীনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর শ্বাশুড়ির নাম ফাতেমা বতুল। তাঁর নানা শ্বশুরও একজন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন এবং ওলীয়ে কামেল ছিলেন। তাঁর নানা শ্বশুরের নাম হযরত আল্লামা আব্দুন নূর সিদ্দিকী (রহঃ)। তাঁর নানা শ্বশুর সাবেক অধ্যক্ষ বাজালিয়া হেদায়াতুল ইসলাম সিনিয়ার মাদ্রাসা ও হুলাইন ইয়াছিন আউলিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসায় সুনাম ও দক্ষতার সহিত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চুনতী হাকীমিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত মুহাদ্দিস এবং পদুয়া হেমায়াতুল ইসলাম সিনিয়ার মাদ্রাসার সাবেক মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি চুনতী মিয়াজী পাড়া হযরত শাহ আবু শরীফ (রাহঃ)জামে মসজিদে পেশ ইমাম ও খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি চন্দনাইশ সাতবড়ীয়া আরিফ শাহ পাড়া জামে মসজিদ এবং কুসুমপুরা জামে মসজিদ, পটিয়া (জিরি) এ ইমাম ও খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এমন কি তিনি বাংলাদেশ ছাড়া বার্মা (মায়ানমার) এবং ভারতের কাশমীরী গেইট, উঁচী মসজিদ দিল্লী তে পেশ ইমাম ও খতীব হিসেবে নিবিড়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতের দিল্লী প্রদেশে“শ্রেষ্ঠ খতীব” হিসেবে সম্মাননা সনদ এবং পুরস্কার লাভ করেন। এমন কি এই আলেমে দ্বীনকে অভিজ্ঞ অধ্যক্ষ ও প্রশাসক হিসেবে স্বীকৃতি স্বরুপ চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্য্যায়ে “শ্রেষ্ঠ শিক্ষক” হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেন। যিনি একই সাথে চুনতীর ঐতিহাসসিক ১৯ দিন ব্যাপী মাহফিলে সিরাতুন্নবী (সাঃ) এর প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহ হাফেজ আহমদ (রহঃ) এর শ্বশুর ছিলেন।
মুফতি মাওলানা আমিনুর রহমান ( রহঃ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স শেষ করার পর মাদিনা ইউনিভার্সিটিতে উচ্চ শিক্ষার জন্য স্কলারশিপে সুযোগ পায়। কিন্তু তিনি তাঁর দাদা মুফতি শফিউর রহমানের নির্দেশে সেখানে না গিয়ে তাঁর দাদার প্রতিষ্ঠিত জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় শিক্ষাকতায় যোগদান করেন। তিনি ছাত্রদের কে কুরআন-হাদিসের পাশাপাশি ধর্মীয় ও আরবী শিক্ষা দিতেন , ইসলামী আদর্শ ও চেতনা জাগ্রত করা, আদর্শবান ও চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলা, হানাফি মাযহাবের আলোকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত তথা সুন্নী মতাদর্শ প্রচার প্রসার করাই এই আলেমে দ্বীনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো । যার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে সুন্নী মতাদর্শ ভিত্তিক ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপুল সংখ্যক কর্মীবাহিনী। তিনি একজন আলা হযরত গবেষক,রেযা প্রেমিক, রেজভী সাহিত্যচর্চার একনিষ্ঠ সেবক, কাদেরিয়া রেজভীয়া তরিকতের বিশিষ্ট খাদেম হিসেবে মাযহাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রচার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
তিনি ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি শুরু করেন।বিভিন্ন ম্যাগাজিন, মাসিক পত্রিকা , দৈনিক পত্রিকা সহ আঞ্চলিক ও জাতীয় পত্রিকায় তাঁর ৫০০ শতাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গবেষণা ধর্মী লেখা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া তিনি অসংখ্য কিতাব অনুবাদ ও রচনা করেন। বিশিষ্ট লেখক,অনুবাদক ও গবেষক অধ্যক্ষ মুফতি মাওলানা আমিনুর রহমান এর অনুদিত ও লিখিত বইসমূহ:প্রকাশিত:
১।ইসলাম ও খৃষ্টবাদ।২।ত্রি-রত্ন সেমিনার: প্রতিবেদক।৩।রেফাঈয়া তরীকতের মূলনীতি।৪।গাউছুল আযম খুলনবী (রহ)।৫।চারজন বরেণ্য রেজভী গবেষক।৬।মুহাদ্দিসে আযমে পাকিস্তান(রহ)।৭। ওয়াতে খাচ।৮।খন্দানে রেজভীয়া: পরিচিতি ৯।প্রাচ্যবিদগণের নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতিত্ব।১০।তরীকতের ধানাবলীরর মর্মকথা।১১।মাতা-পিতার হক।১২।গ্রন্থ পরিচিতি ও লেখক পরিচিতি।১৩।হাদীস শাস্ত্রের ইতিহাস।১৪।জশনে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।
১৪।মুফতী সৈয়দ আমীমুল ইহছান (রহ)’র গ্রন্থবলী।
১৫।অনুবাদ: আল অজীফাতুল কারীমাহ (মূল: ইমাম আহমদ রেযা খান)
১৬।মি’রাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।
১৭।মাশায়েখে কাদেরীয়া রেজভীয়া:পরিচিতি।
১৮।মুফতী সৈয়দ আমীমুল ইহছান (রহ) আধ্যাত্মিক জীবন।
১৯।সংক্ষেপে সীরাতে রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।
২০।ফরয নামাজান্তে মুনাজাতের বিধান।
২১।মৃত্যুর পর ঘরে আত্মার আগমন।
২২।স্বপ্নযোগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।
২৩।নবীগণের জন্য আলায়হিমুছ ছালাম বলা প্রসঙ্গে।
২৪।আদবে শায়খ ও মুরীদান।
২৫।মাযারে গম্বুজ নির্মাণে ফায়সালা।
২৬।বৃদ্ধা আঙ্গুলে চুম্বনের বিধান।
২৭।ইসলাম, বিজ্ঞান ও ইমাম আহমদ রেযা।
২৮।সিরাজুম মুনীর।
২৯।তাওসীফে মিল্লাত এর স্বরণীয় সফরে হজ্ব।
অপ্রকাশিত:
৩০।মুফতীয়ে আযমে হিন্দ ও তাঁর খোলাফা।
৩১।মুফতী আহমদে খান নঈমী : জীবন ও কর্ম।
৩২।কুতুবীয়ে মাদীনা : জীবন ও কর্ম।
৩৩।জিয়া এ মাদীনা : জীবন ও কর্ম।
৩৪। গাজ্জালিয়ে জামান।
৩৫।সৈয়্যিদ কাজেমী : জীবন ও কর্ম।
৩৬।ইউসুফ বিন ঈসমাইল নাবহানী:জীবন ও কর্ম।
৩৭।মুফতী সৈয়্যদ আমীমুল ইহসান (রহ):জীবন ও কর্ম।
৩৮।আল্লামা সদরুল আফাজিল: জীবন ও কর্ম।
৩৯। সবুজ গম্বুজ : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। বহু প্রতিভাবন ব্যক্তিত্ব অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ আমিনুর রহমান আলেম সমাজ এবং লেখক ও গবেষক সমাজের অহংকার। আল্লাহ পাক তাঁর এই দ্বীনী খেদমতকে কবুল করুক। তিনি বাংলাদেশ মুসলমান ইতিহাস সমিতির উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের পরামর্শক ছিলেন।ব্যক্তিগত ভাবে আমার সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিলেন। তাঁর শশুর মাওলানা ফখরুদ্দিন ( রহঃ) আমার পিতা মাওলানা মোহাম্মদ আলী সাহের বাল্য বন্ধু ছিলেন। সে সম্পর্কের কারনে আমাকে তিনি স্নেহ করতেন। এই মহা মনীষী ৬ ডিসেম্বর ২০২২ মঙ্গলবার রাত ৮.৩০ টায় ইন্তেকাল করেছেন। ৭ ডিসেম্বর বুধবার বাদে আসর জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা মাঠে হাজার হাজার মুসলমান জনতার উপস্থিতিতে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করুক। আমীন।
লেখক :সভাপতি, সিএইচআরসি, বাংলাদেশ।
সি-তাজ২৪.কম/এস.টি
Sign in
Sign in
Recover your password.
A password will be e-mailed to you.