মাওলানা ইসলামাবাদীর হৃদয় প্রশান্ত মহাসাগরের মতো
২২ আগস্ট ২০২৪, ইসলামাবাদীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী স্মরণে
মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮), জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬), নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫), মাওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮), শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২), সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১), মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮), মাওলানা শওকত আলী (১৮৭৩-১৯৩৯) প্রমুখ ব্যক্তির সাথে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৪-১৯৫০)’র রাজনৈতিক সখ্যতা ও রাজপথে একসাথে আন্দোলনের ইতিহাস চমৎকারভাবে ইতিহাসে উপস্থাপিত হয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। উল্লিখিত দেশবিখ্যাত রাজনীতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে রাজনীতি, শিক্ষা-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। মাওলানা ভাসানী ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁদের আত্মজীবনীতে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর স্নেহ ও ভালোবাসার কথা বারেবারে উল্লেখ করেছেন। ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের জগদ্বিখ্যাত রাজনীতিক মহাত্মা গান্ধী ইসলামাবাদী সম্পর্কে বলেছেন, “মাওলানা ইসলামাবাদীর হৃদয় প্রশান্ত মহাসাগরের মতো।” মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের কৃতীপুরুষ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার শ্রমমন্ত্রী । শ্রম আন্দোলনের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। শুদ্ধ রাজনীতির প্রতিকৃত মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী। জহুর আহমদ চৌধুরী চট্টগ্রামের কৃতীপুরুষ মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘শ্রদ্ধেয় মাওলানা ইসলামাবাদী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বীরযোদ্ধা ও প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তাঁকে একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অন্যদিকে এক শ্রেণীর আলেম ও স্ব-সমাজের স্বার্থপর লোকদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করতে হয়েছিলো। ইসলামের আদর্শ ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কায়েম করার জন্য তিনি পাগলের ন্যায়ে কাজ করে গেছেন। তাঁর পুত্র মরহুম সুফীর সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিলো। ইসলামাবাদীর কলকাতার বাসভবনে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। আমরা দেশ সেবকদের সম্মান দিতে জানিনা। আমরা ভুলে গেছি দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তকে, শাহ মোহাম্মদ বদিউল আলমকে, কাজেম আলী মাস্টার প্রমুখকে।
কংগ্রেসে মাওলানা ইসলামাবাদী সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। একবার আসামে কংগ্রেস সম্মেলনে মাওলানা হোসাইন আহম্মদ মাদানী সাহেবকে মাওলানা ইসলামাবাদী বেশ কিছুদূর অগ্রসর হয়ে অভ্যর্থনা জানান। আসামের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী বরদলুই এ বিষয়টি মহত্মা গান্ধীর নিকট উত্থাপন করেন। মহত্মা গান্ধী বলেন, “মাওলানা ইসলামাবাদীর হৃদয় প্রশান্ত মহাসাগরের মতো।” মাওলানা মাদানীকে সম্মান প্রদর্শনের অর্থ নিশ্চয় আমাদের কারো প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়। এদেশে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন। এই লক্ষে চট্টগ্রাম আনোয়ার পটিয়া এলাকার কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী দেয়াং পাহাড় হাজারো কানির অধিক জায়গা দান মুলে ও বঙ্গ সরকার থেকে লিজ নিয়েছিলেন তিনি । প্রাথমিক ভাবে তিনি এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনও করে কারিগরি শিক্ষা বিভাগ চালুও করেছিলেন। পবিত্র ইসলামের আদর্শে মানুষ গড়ে তোলাই ছিলো তাঁর প্রধান লক্ষ্য। অনগ্রসর অবহেলিত মুসলমান জাতিকে শিক্ষাদান এগিয়ে আনতে তিনি বেশ উন্নয়ন, সেবামূলক কাজ করেছিলেন।” মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রসঙ্গে মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী আরো বলেন, “শুধু দেশবাসী নয় বহু নেতাও তাঁর কাছে ঋণী। কৃষক প্রজাদলের সহ-সভাপতি হিসেবে তিনি শেরে বাংলা একে ফজলুল হক কে সব সময় উত্তম পরামর্শ দিতেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে তাঁর ছিলো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তিনি তাঁকে মোহাম্মদি পঞ্জিকা কিনে উপহার দিয়েছিলেন। দেশকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন করার জন্য নেতাজীর ভারত ত্যাগের সংবাদ তিনি জানতেন। তাই পরের দিন তাঁর বাসভবনে মাওলানা ইসলামাবাদী খুবই চিন্তামগ্ন ছিলেন। সেদিন কিন্তু কথা বলার সাহস পায়নি আমি। আমরা যদি মাওলানা সাহেবকে ভুলে যায়, তবে তাঁদের প্রতি চরম অবিচার হবে৷ তাঁর মহান স্মৃতি রক্ষা করা আমাদের মহান কর্তব্য।” ১৯৭৪ সালে ২৪ মার্চ ঢাকায় মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর স্মরণে আয়োজিত বাংলাদেশ সমাজ কল্যাণ সমিতির সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টল কৃতীপুরুষ মন্ত্রি জহুর আহমেদ চৌধুরী লিখিত ভাষন এটি। এই প্রবন্ধের সাথে আলোচিত বিখ্যাত রাজনীতিবিদের সাথে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সম্পর্ক ছিলো, শুধু তাঁদের আলোকচিত্র দিয়ে ইসলামাবাদীর একটি পোস্টার তৈরি করে চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র (সিএইচআরসি) ২০২২ সালে মাওলানা মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর মৃত্যু দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। আসুন লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ,শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম, চন্দনাইশের আর্দশ অনুস্মরন কারী ব্যক্তিবর্গ, আমি, আপনি একটু হলেও এই মনীষীর জীবন চর্চা করে বর্তমান প্রজন্মকে শুদ্ধ পথের সন্ধানে গড়েতোলতে চেষ্টা করি। মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ( অনুমান জন্ম ১৮৭৫/৭৪, ২২ আগস্ট Ñ মৃত্যু ১৯৫০, ২৪ অক্টোবর )। তিনি ইসলামী চিন্তাবিদ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও জননেতা, রাজনীতিবিদ, কৃষক নেতা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, অনুবাদক, বহুগ্রন্থের প্রনেতা, বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচিত মেম্বার ছিলেন। তিনি বাংলা, আরবি, ফার্সি ও উর্দুতে লেখালেখি করেন। বাংলায় মুসলিম যুগে চট্টগ্রামের সরকারি নাম ইসলামাবাদের নামানুসারেই তিনি নিজের নামে ইসলামাবাদী লিখতেন। মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর জন্ম চন্দনাইশের বরমা ইউনিয়নের আড়ালিয়ার চর গ্রামে। তাঁর পিতা মুন্সি মতিউল্লাহ পন্ডিত। চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা ও কদম মোবারক বালক বিদ্যালয় তাঁর কর্মের মহান সাক্ষর ও উজ্জল সাক্ষী। এতিম খানার সম্মুখে নবাব ইয়াসিন খানের নির্মিত কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ। মসজিদ সম্মুখে ইসলামাবাদীর সমাধি রয়েছে।
লেখক: ইতিহাসবেত্তা, বহু গ্রন্থপ্রনেতা,সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র।