ইতিহাস কোনো নিছক অতীত বর্ণনা নয়— এটি হলো ভবিষ্যতের আলোকে বর্তমান বিশ্লেষণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। মানবজাতির যাত্রাপথ, তার উত্থান-পতন, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্ম, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও মনীষীদের অবদান নিয়ে যুগে যুগে অসংখ্য ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তবে বাংলা ভাষায় এমন একটি বই খুবই বিরল, যেখানে বিশ্ব ইতিহাসের এমন ব্যাপক, গভীর ও বিস্তৃত উপস্থাপন পাওয়া যায়। এ প্রেক্ষিতে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক সোহেল মো. ফখরুদ-দীন সম্পাদিত ও রচিত ‘বিশ্ব ইতিহাস পরিক্রমা’ নিঃসন্দেহে এক অসামান্য কীর্তি।

বইটি প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার বুক মিউজিয়াম প্রকাশনা থেকে, যার প্রধান সম্পাদক ইতিহাসবিশারদ আজিজুল হক, একজন খ্যাতনামা গবেষক ও শিক্ষাবিদ। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ডায়মন্ড হারবার এলাকার নিবেদিতপ্রাণ ইতিহাসচর্চাকari।
বিশাল এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় অক্টোবর ২০২৪ সালে, এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে এর দ্বিতীয় পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় জুন ২০২৫-এ। বইটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ২০৬৪, যা বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
‘বিশ্ব ইতিহাস পরিক্রমা’ গ্রন্থের আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা উৎসব পশ্চিমবঙ্গের লাব্বাইক মিশন সভাগৃহে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সভাপতিত্ব করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামিক গবেষক ড. আবদুল হামীদ কাসেমী। এ আয়োজনে অংশ নেন বহু সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, কবি, সাংবাদিক ও সমাজসেবক। প্রকাশনা অনুষ্ঠানটি শুধু একটি বই উদ্বোধনের কর্মসূচি ছিল না— এটি হয়ে উঠেছিল ইতিহাস চর্চার নবজাগরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
এই বইয়ের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর তথ্যঘন ও দৃষ্টিনন্দন বিন্যাস। গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে বিশ্বের ২০৬টি দেশের ইতিহাস, যার মধ্যে ১৯৩টি জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র। আলোচিত হয়েছে পৃথিবীর ৭টি মহাদেশ, ৫টি মহাসাগর, ২৭টি সাগর এবং জল ও স্থলভাগের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য। বইটি পাঠককে শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় বা এলাকা নিয়ে জানায় না, বরং মানব সভ্যতার উন্মেষ থেকে আধুনিক যুগের প্রযুক্তি ও রাষ্ট্রনীতি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়।
বইটির বিষয়বস্তুর বিশালতা আরও বিস্ময়কর হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় এখানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
১০০ জন খ্যাতনামা বিশ্বনেতার জীবন ও কার্যক্রম, ৫০০ বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারকের গবেষণা ও আবিষ্কারের বিবরণ, ৫০ জন ধর্মীয় মনীষীর জীবনদর্শন ও সমাজে তাঁদের প্রভাব।
শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম, সভ্যতা, ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে ৫০০-এর অধিক বিষয়ের বিশ্লেষণ।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, গ্রন্থটিতে ভাষাবিজ্ঞান ও ভাষার বৈচিত্র্য বিষয়েও বিশদ আলোচনা রয়েছে। পৃথিবীর মোট ৭০৯৯টি ভাষার তালিকা এবং বাংলাভাষার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে তথ্যনির্ভর আলোচনায় বইটি হয়ে উঠেছে ভাষাপ্রেমীদের জন্যও এক আকর্ষণীয় দলিল। এছাড়া শিক্ষার ইতিহাসের বিশ্লেষণ, প্রাচীন ও আধুনিক মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিবরণ, বিশ্বজুড়ে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ও প্রভাব—এসব বিষয় পাঠককে সমকালীন ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
‘বিশ্ব ইতিহাস পরিক্রমা’ বইটি ইতিহাসকে শুধুমাত্র শুষ্ক তথ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং লেখকের সুগঠিত বিশ্লেষণ, পাঠকবান্ধব ভাষা ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি এটিকে এক অনন্য গবেষণাধর্মী গ্রন্থে রূপান্তর করেছে। এখানে আছে রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম, বিজ্ঞান, যুদ্ধ, আন্দোলন, উপনিবেশবাদের প্রভাব, শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি ও সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন অধ্যায়। ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক এখানে যত্নসহকারে তুলে ধরা হয়েছে।
এই গ্রন্থ কেবল একজন ইতিহাসবিদের গবেষণা নয়— এটি এক গবেষকের সামাজিক দায়িত্ববোধ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইতিহাসচর্চায় উদ্বুদ্ধ করার এক যুগান্তকারী প্রয়াস। বর্তমান প্রজন্ম যখন প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারেও ভেসে যাচ্ছে, তখন ইতিহাসভিত্তিক এমন একটি গ্রন্থ তাঁদেরকে অতীত জানার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারে।
এমন একটি পরিশ্রমসাধ্য কাজ বাস্তবায়নের পেছনে রয়েছে নিরলস অধ্যবসায়, সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি এবং একাডেমিক দায়িত্বশীলতা। এই বই ইতিহাস গবেষণা ও পাঠে যেমন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে, তেমনি এটি পাঠ্যক্রম, গবেষণা, প্রবন্ধ রচনা ও জ্ঞানচর্চার নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবেও ব্যবহারযোগ্য।
‘বিশ্ব ইতিহাস পরিক্রমা’ শুধুমাত্র একটি ইতিহাস গ্রন্থ নয়, বরং এটি একটি বিশ্বজ্ঞান-ভান্ডার। ইতিহাসের বিশাল পটভূমিতে দাঁড়িয়ে এটি সময়ের দলিল হয়ে উঠেছে। পাঠক, গবেষক, ছাত্র-শিক্ষক, এমনকি সাধারণ পাঠকের জন্যও বইটি হবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এক অমূল্য সম্পদ। বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার পরিসরকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে এই বই একটি গৌরবোজ্জ্বল সংযোজন— যা আগামী প্রজন্মের ইতিহাসবোধ ও জ্ঞানচর্চায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
লেখক: সম্পাদক তাজ২৪.কম ও মাসিক আলোর পথে।
সি-তাজ২৪.কম/এস.টি