—জিএম মামুনুর রশিদ
৫২তম শাহাদাতবার্ষিকী সেই মানুষটির, যিনি চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন— এ.কে.এম ফজলুল কাদের চৌধুরী। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকারী, সরকারের ১৮টি সেক্টরের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এই মহান “সিংহপুরুষ” শুধু একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, বরং ছিলেন দূরদর্শী উন্নয়নদর্শী এক রাষ্ট্রনায়ক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, চুয়েটসহ বহু প্রতিষ্ঠান তাঁর চিন্তা ও কর্মের ফসল হলেও আজ দুঃখজনক বাস্তবতা হলো—এইসব প্রতিষ্ঠানের কোথাও তাঁর নাম নেই, নেই কোনো ভবন বা হল তাঁর স্মৃতিতে। ইতিহাস যেন তাঁকে ভুলে যেতে চায়, কেবল এজন্য যে তিনি মুসলিম লীগ নেতৃবর্গের একজন ছিলেন এবং শহীদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পিতা ছিলেন।
১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জাকির হোসেনের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করান। যদিও সে সময় কুমিল্লা ও সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে ব্যাপক আন্দোলন ও চাপ প্রয়োগ করছিল, ফজলুল কাদের চৌধুরী অটল থেকে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যান।
পরে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আদেশ আনতে হলে তাঁকে আত্মত্যাগ করতে হয় মন্ত্রীত্ব, নিতে হয় জাতীয় পরিষদের স্পীকারের দায়িত্ব—এবং সেই সুযোগে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে হাটহাজারীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বাক্ষর করেন। তাঁর দৃঢ় মনোবল ও অকুতোভয় মনোভাবের ফলেই আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবে রূপ নিতে পেরেছে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে তাঁর নামটিও উচ্চারিত হয়নি। উপাচার্যসহ বক্তারা জাতির জনক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান স্মরণ করলেও, যে ব্যক্তি প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তব রূপ দেওয়ার পেছনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁকে সম্মান জানানো হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা তহবিল জোগাড়ে তখনকার সময়ের ২৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবুল খায়ের সিদ্দিকী, যা আজকের কোটি টাকারও বেশি। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সমাজসেবকরা এ অর্থ দিয়েছেন, কিন্তু আজ তাঁদের কেউ মনে রাখে না।
আজকের প্রজন্ম হয়তো জানে না, চট্টগ্রামের উন্নয়নের পেছনে এই মানুষটির অবদান কতটা গভীর। তিনি শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই নন, রাউজানের পাহাড়তলীতে চুয়েটসহ বহু প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন।
অবিভক্ত পাকিস্তান জাতীয় সংসদের স্পীকার জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব হযরত সায়্যিদ আহ্মাদ শাহ্ সিরিকোটী رحمۃ اللہ علیہ’র প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিলেন; সিরিকোটী সাহেব رحمۃ اللہ علیہ’র আমন্ত্রণে একবার তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের জেলা হরিপুরে হযরত খ্বাজা আব্দুর রহ্মান ছোহার্ভী رحمۃ اللہ علیہ প্রতিষ্ঠিত দারুল উলূম রহমানিয়া পরিদর্শন করতে যান এবং এর আযীমুশ শান ভবন এবং চমৎকার পরিচালনা ব্যবস্থা দেখে যথেষ্ট প্রভাবিত হন এবং তৎকালীন সময়ের ৫০ হাজার রুপী দারুল উলূমের খিদমাতের উদ্দেশ্যে পেশ করেন।
জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব একবার সিরিকোট শরীফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং প্রস্তরাবৃত দীর্ঘ গিরিপথ বেয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন। সেসময় সিরিকোট শরীফের পর্বতাশ্রিত পথে গাড়ি চলাচলারের উপযোগী কোনো রাস্তা ছিলো না। পায়ে হেঁটে সকালে পর্বতের নিচ থেকে রওয়ানা দিলে সিরিকোট পর্যন্ত পৌঁছাতে রাত হয়ে যেতো। আরেকটি উপায় ছিলো গাধার পিঠে বসে এই পথ অতিক্রম করা, এতে মোটামুটি কয়েক ঘন্টায় পৌঁছানো সম্ভব হতো। হযরত সায়্যিদ আহ্মদ শাহ্ رحمۃ اللہ علیہ’র প্রতি গভীর ভালোবাসা ও অনুরক্তির কারণে পরবর্তীতে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব সিরিকোট শরীফে গাড়ি চলাচলের উপযোগী রাস্তা নির্মানের উদ্যোগ নেন এবং তাঁর তত্ত্বাবধানেই সর্বপ্রথম সিরিকোট শরীফে রাস্তা নির্মিত হয়।
শারাফ এ মিল্লাত আল্লামা আব্দুল হাকীম শারাফ ক্বাদিরী رحمة الله عليه লিখেন: “দ্বীনের আনুগত্যে শহীদ জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী [আল্লাহ্ তাঁকে রহমতে নিমজ্জিত করুন] – হযরত সায়্যিদ আহ্মাদ সিরিকোটী رحمة الله عليه’র নিয়ায-মান্দ্ (মুরীদ)-দের একজন ছিলেন।”
চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার প্রথম অধ্যক্ষ ওয়াক্বার’এ মিল্লাত মুফতী ওয়াক্বারুদ্দীন ক্বাদিরী رحمة الله عليه’র ব্যাপারে জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী বলতেন “আলিম’এ দ্বীন কেবল একজনই তো আছেন যিনি আমাকে মুতমাইন (প্রশান্ত) করতে পারেন, এবং তিনি হলেন মুফতী ওয়াক্বারুদ্দীন।”
ইমামে আহলে সুন্নাত আজিজুল হক্ব শেরে বাংলা (রহঃ) ও গহিরা কামিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা সৈয়দ দোস্ত মুহাম্মদ (রহঃ)’র সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ গভীর সম্পর্ক ছিলো। তিনি দ্বীন মাজহাব মিল্লাত তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের ব্যাপক খেদমত করেছেন।
ফজলুল কাদের চৌধুরীর ৫২তম শাহাদাতবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। ইতিহাসকে রাজনৈতিক রঙ দিয়ে নয়, ন্যায়ের দৃষ্টিতে বিচার করা উচিত। মহান আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন। আমিন।
প্রতিষ্ঠাতাঃ— জুঁইফুল
পরিবেশবাদী শিশু উন্নয়ন, শিক্ষা-সামাজিক, মানবিক সংগঠন।
সি-তাজ২৪.কম/এস.টি