বড় পীর গাউসূল আজম,মাহবুবে সোবহানী,গাউসে সামদানী,কুতুবে রাব্বানী সৈয়দ হজরত শেখ মহিউদ্দিন আব্দুল কাদির জিলানী (রহ:) জীবনী :
সোহেল তাজ
ফাতেহা-ইয়াজদহম’ বা ‘গিয়ারভী শরীফ :
হযরত গাওসুল আজম হিজরী ৫৬১ সালের রবিউস সানী মাসে ওফাত পান। খ্রিস্ট সাল অনুযায়ী যা ছিল ১১৬৬ সাল, তারিখ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। ৮, ৯, ১১, ১৩ এবং ১৭ পর্যন্ত এ পাঁচটি তারিখের উল্লেখ পাওয়া গেলেও সর্বসম্মত মত হচ্ছে ১১ রবিউস সানী। ফারসি ভাষায় ১১ কে ইয়াজদহম এবং উর্দুতে ‘গিয়াবা’ বলা হয়। এবং গিয়াবা থেকে ‘গিয়ারভী’ শরীফের উৎপত্তি। হযরত গাওসুল আজমের ওফাত দিবস ‘ফাতেহা-ইয়াজদহম’ বা ‘গিয়ারভী শরীফের’ প্রথমোক্ত নামটি অধিক পরিচিত এবং সূচনা কাল থেকেই এখানে প্রচলিত।
জন্ম :
জগত বিখ্যাত এ মহান ওলী হিজরী ৪৭০ সালের ১ রমজান মোতাবেক ১০৭৭-৭৮ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং হিজরী ৫৬০-৬১ সাল মোতাবেক ১১৬৬ খৃস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯০-৯১ বছর।পারস্যের জিলান শহরকে আরবীতে “কিলান”ও বলা হয়। তার পিতা হলেন সায়্যিদ আবু সালেহ মূসা জঙ্গী রহ:। তিনি তার সময়ের শ্রেষ্ট বুযুর্গ, যাহিদ, আল্লাহওয়ালা ছিলেন। তার দুনিয়া বিরাগ সবার মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল। হযরত বড়পীর দস্তগীর রহ: এর মায়ের নাম সায়্যিদা উম্মুল খায়ের ফাতিমা রহ:। আম্মাজানও ছিলেন মশহুর হাফিজা ও আবিদা। পিতা-মাতা উভয় দিক থেকেই বড়পীর রহ: নবী কারীম (সা:) বংশের ছিলেন। পিতার দিক থেকে তিনি হযরত ইমাম হাসান রা. এর বংশধর আর মায়ের দিক থেকে ইমাম হুসাইন রা. এর বংশধর।
শিশু অবস্থায় হযরত বড়পীর রহ: এর অলৌকিক বিষয় তার বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থে এসেছে। তা হলো— তিনি রামাদান মাসে দিনের বেলা তার মায়ের দুধ পান করতেন না। বরং ইফতারের সময়ের পর তিনি দুধ পান করতেন। (সূত্র: আত তিরাযুল মুযাহহাব ফি মাওলিদিল বাযিল আশহাব)
বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহ: এর কারামত সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনে কিরামের বক্তব্য হলো— শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী রহ: এর কারামত মুতাওয়াতির পর্যায়ের। যা অন্য কোন বুযুর্গের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। আল্লামা দামিরী (রহ:), ইমাম যাহাবী ( রহ.) এর মতো বিখ্যাত ইমামগণ তার কারামত বর্ণনা করেছেন। তবে তার নামে সমাজে কিছু ভুয়া বানানো কারামাত প্রচার করা হয়। এগুলো থেকেও সতর্ক থাকা জরুরী। “কালাইদুল জাওয়াহির” কিতাবের লেখক বলেন, বড়পীর র. এর থেকে অধিক কারামত প্রকাশিত হওয়ার বিষয়ে আলেমগণ একমত। তার বড় একটি কারামত হলো তার ফায়য ও তাওয়াজ্জুহর বদৌলতে যেকোনো মৃত কলব জীবিত হয়ে যেত। এ জন্য তার প্রত্যেক মজলিসেই ইয়াহুদী নাসারা সহ অন্যান্য বিধর্মীরা মুসলমান হতো।
মুহিউদ্দীন উপাধি :
গাউসুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী (রহ:) যে সময়ে এ পৃথিবীতে আসেন সে সময়ে পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোর অবস্থা বেশ নাজুক ছিল। একদিকে গ্রীক ও পাশ্চাত্য দর্শনের বিভ্রান্তিতে মুসলমানরা তাওহীদ থেকে সটকে পরার উপক্রম। অন্যদিকে মুসলিম রাজ্যগুলো ধ্বংস করার জন্য মোঙ্গল ও ক্রুসেডদের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা। মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা একজন মুজাদ্দিদের (দ্বীন সংস্কারক) প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।মুসলিম মিল্লাতের এক কঠিন সময়ে বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহ: এর জন্ম হয়। তার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দ্বীন ইসলামকে পুনর্জীবন দান করেন। এ জন্য বড়পীর রহ: কে ” মুহিউদ্দীন” (দ্বীন পুনর্জীবিতকারি) বলা হয়। নবী (সা:) এরশাদ করেন, ‘‘প্রত্যেকে তাই করবে যে জন্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’’ [বুখারী]। নবী (সা:) আরও এরশাদ করেন ‘‘যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তার জন্য সে কাজকে সহজ করে দেয়া হয়েছে। [বুখারী] ।
বাল্য জীবন :
বাল্যকালেই বড়পীর রহ: তাঁর বুযুর্গ পিতাকে হারান। তার পিতৃবিয়োগের কারণে তিনি মমতাময়ী মা এবং নানা সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আস-সাউমাঈ (রহ:) এর তত্ত্বাবধানে বড় হন। তার নানা সে সময়ের অন্যতম বুযুর্গ আল্লাহওয়ালা ছিলেন। গাউসুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী রহ: নানাজান সাইয়্যিদুল আউলিয়া সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আস-সাউমাঈ (রহ:) কাছে কুরআন কারীম হিফয করেন এবং আরবী ভাষা ও ফিকহের প্রাথমিক কিতাবাদি অধ্যয়ন করেন। জিলানের আলেম উলামার কাছ থেকেও জ্ঞানার্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি বাগদাদে গিয়ে পড়াশুনা করার ইচ্ছা করেন। কারণ সে সময়ে বাগদাদ ছিল ইলমের রাজধানী। দুনিয়ার বড় বড় আলেম উলামাকে বাগদাদ শহর স্বাগতম জানাতো। বড়পীর (রহ:) বাগদাদে যাওয়ার ইচ্ছা হলে তার মমতাময়ী মাকে অবগত করেন। তখন তার মায়ের বয়স ছিল ৭০ বছর এবং তার বয়স ছিল ১৮ বছর। সায়্যিদাহ ফাতিমা রহ: তাকে বাগদাদ যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন।
ডাকাতদলের তাওবাহর ঘটনা :
বাগদাদ যাওয়ার পথে তারা একদল ডাকাতের আক্রমণের স্বীকার হন। এ ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ,বড়পীর রহ: জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় তার মা জননী তাকে ৪০ দিনার (স্বর্ণমূদ্রা) প্রদান করেন এবং বিভিন্ন নসীহত করেন। তার মাতা তাকে বাগদাদে পাঠানোর প্রাককালে চল্লিশটি দিরহাম তার কাপড়ে সেলাই করে দিলেন। এবং মিথ্যা কথা না বলার জন্য নছিয়ত করেন। পথি মধ্যে একদল দস্যু কর্তৃক তার কাফেলা আক্রানত হল। সবার কাছ থেকে সবকিছুই লুট পাট করে নিল। আব্দুল কাদের জিলানী একপাশে দাড়ানো ছিলেন। দস্যুরা তার কাছে কিচু আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন,তার কাছে চল্লিশ দিরহাম আছে। অতঃপর তারা আব্দুল কাদের জিলানী (রহ:) কে তাদের সর্দারের কাছে নিয়ে গেলেন। সর্দার পুনরায় তার কাছে জানতে চাইলো একথা সত্য কিনা? গাউছুল আযম নির্দ্বিধায় বললেন,তা সত্য। দস্যু সর্দার জানতে চাইলো,এ রকম অকপটে সত্য কথা বলার কারণ কি? গাউছুল আযম বললেন, মায়ের নির্দেশ সর্বাবস্থায় সত্য কথা বলার। একথা শুনে দস্যু সর্দারের ভাবানতর সৃষ্টি হল, এবং মনে হতে লাগলো এ বালক তার মায়ের আদেশ পালন করার নিমিত্তে নিজের শেষ সম্বলটুকু হাতছাড়া হবে জেনেও অকপটে সত্য কথা বললো আর আমরা আল্লাহ ও রাসুলের (সা:) নির্দেশ ভুলে গিয়ে আজীবন মানুষের উপর কতইনা অত্যাচার জুলুম করে চলেছি। বড়পীর রহ: এর সত্যবাদিতার গুনের কারণে ডাকাতদল তাওবাহ করে দ্বীনের পথে ফিরে আসে।
শিক্ষা জীবন :
৪৮৮ হিজরীতে (১০৯৫ খৃস্টাব্দ) বড়পীর (রহ:) বাগদাদ প্রবেশ করেন। তখন মুসলিম বিশ্বের শাসনকার্যে ছিলেন আব্বাসীয় খলীফা মুসতাজহার বিল্লাহ। বাগদাদ পৌঁছে হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহ: তদানীন্তন মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা-এ-নিযামিয়ায় ভর্তি হন এবং সে সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান তাপসদের তত্ত্বাবধানে অল্প সময়ের মধ্যেই ইলেম শারীআত, ইলেম লুগাত, ইলেম ফিক্হ, ইলেম তাফসির, ইলেম কিরাআত, ইলমে তাসাউফসহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। বাগদাদে বড়পীর রহ: এর উস্তাদগণের মধ্যে হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীদের সংখ্যা বেশি ছিল। বড়পীর রহ: নিজেও হাম্বলী মাযহাব অনুসরণ করতেন। তবে তিনি হাম্বলী ও শাফেঈ উভয় মাযহাবের মুফতী। এ বিষয়ে ইমাম নববী রহ: বলেন, (বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী (রহ:) তিনি বাগদাদে শাফেঈ ও হাম্বলী মাযহাবদ্বয়ের ফকীহ ছিলেন। গাওছুল আযম হযরত আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) একই সঙ্গে শরীয়ত ও তরীকতের মহান সাধক ছিলেন। তাঁর আরবী ভাষায় রচিত কাসীদা-ই-গওসিয়া তাঁর রুহানী ক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পবিত্র কোরআন ও মহানবী (স.)-এর সুন্নাহ ছিল তাঁর মহান আদর্শ। বড়পীর রহ: এর ইলমী গভীরতা খুব বেশি ছিল। সমকালীন আলেমগণ তার দারসে বসে উপকৃত হতেন।
ইমাম আব্দুল ওয়াহাব শা’রানী (রহ:) বলেন, শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী রহ: জ্ঞানের ১৩ টি শাখা নিয়ে কথা বলতেন। ছাত্ররা তার মাদরাসায় তার কাছে তাফসীর, হাদীস, ইলমে ফিকহ, ইখতিলাফী মাসাইল অধ্যয়ন করত। সকাল সন্ধা তিনি তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, উসুল, নাহু এগুলো পড়াতেন। যুহরের পর তাজবীদসহ কুরআন কারীম পড়াতেন। তিনি শাফেঈ ও হাম্বলী মাযহাবের আলোকে ফতওয়া দিতেন। (সূত্র: আত তাবাকাতুল কুবরা)।
বড়পীর রহ: এর জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে তার ছাত্র ইবনু কুদামাহ বলেন, আমি ৫৬১ হিজরীতে বাগদাদে প্রবেশ করি। আমি লক্ষ্য করলাম ইলম, আমল, ফতওয়া সবকিছুর দৌড় আব্দুল কাদির জিলানী রহ: এর কাছে গিয়ে শেষ হয়। তার দারসে যারা বসেছে তাদেরকে ইলম অর্জনের জন্য আর কোথাও যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তাআলা তাকে অনেক গুণাবলি দান করেছেন। আমি তার সমতুল্য আর কাউকে পাই নি।
আধ্যাত্মিক শিক্ষা :
গাউসুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী (রহ:) বাগদাদে ইলমে জাহির অর্জনের পাশাপাশি ইলমে বাতিন তথা ইলমে তাসাওউফও অর্জন করেন। ইলমে তাসাওউফের তা’লিম নেওয়ার জন্য বড়পীর রহ: প্রথমে বায়আত হন বাগদাদের বিখ্যাত সূফী আবু মুহাম্মদ আদ-দাব্বাস রহ: এর কাছে। আব্দুল কাদের জিলানীর (রহ.) তাঁর কাছেই তরীকতের প্রাথমিক দীক্ষা নিয়েছিলেন। শায়খ হাম্মাদ বিন মুসলিম দাব্বাস (রহ.) বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। তিনি প্রথম দর্শনেই আব্দুল কাদের জিলানীর (রহ.) অত্যন্ত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত হয়ে যান। শায়খ হাম্মাদ বিন মুসলিম দাব্বাস (রহঃ) একদিন তামাম শিষ্যদের ভরা মজলিসে তিনি বলেই ফেললেন “সেই সময় সমাগত প্রায়, যখন দুনিয়ার সমস্ত অলি আল্লাহ্গণের গর্দানে থাকবে তাঁর কদম। এই অনারব ব্যক্তির মুখে এক সময় উচ্চারিত হবে একথা, আমার কদম সকল অলি আল্লাহ্গণের স্কন্ধে” তাঁর এই ঘোষনার সময় তখনকার সমস্ত অলি আল্লাহ্গণ তাঁর কদমের উদ্দেশ্যে নিজেদের ঘাড় নত করে দেবে। মহান সাধক শায়েখ হাম্মাদ বিন মুসলিম দাব্বাস (রহঃ) এর সান্নিধ্যে দীর্ঘদিন কাটিয়ে সাধনা পথের সুকঠিন ও বিপদসংকুল বাঁকগুলো একে একে পার হয়ে গেলেন তিনি। কঠিন রিয়াজত ও মুশাহিদার মাধ্যমে তরীকতের সুকঠিন পথ পাড়ি দেবার মত শক্তি ও সাহস সঞ্চার হলো তাঁর নিজের মধ্যে। পরবর্তীতে বায়আত হন হযরত আবূ সাঈদ মাখযুমী (অথবা মুখাররিমী) রহ: এর কাছে। আল্লাহ তাআলা পাওয়ার এই দীর্ঘ পথে বড়পীর রহ: কঠোর রিয়াজত মেহনত করেন। জনমানবহীন জঙ্গলে গিয়ে আল্লাহ মুরাকাবাহ মুশাহাদা, যিকর আযকারে ব্যস্ত থাকতেন। তার রিয়াজত মেহনতের সময়ে তিনি দুনিয়ার যাবতীয় আরাম আয়েশকে পরিত্যাগ করেছিলেন। আহার-নিদ্রা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন তাকে না খেয়েও থাকতে হয়েছে। একসময় ক্ষুধার তাড়নায় তিনি গাছের পাতাও খেয়েছেন। এগুলোর তার রিয়াজতের অংশ ছিল, আবার সে সময়ে বাগদাদে খাদ্য সংকটও দেখা দিয়েছিল। দুনিয়ার ভোগ বিলাস, আরাম আয়েশ পরিত্যাগ করে কামালাতের উচ্চ মাকামে পৌছতে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর রাতজেগে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে সময় কাটিয়েছেন। কামালাত অর্জনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমী রহ: তাকে তাসাওউফের সনদ এবং খিরকা (জুব্বা) প্রদান করেন।
স্বপ্নে রাসূল (সা.) নির্দেশ :
৫২১ হিজরীর ১৬ শাওয়াল রোজ মঙ্গলবার রাসূল (সা.) স্বপ্নযোগে বলেন, হে আবদুল কাদির! তুমি মানুষকে কেন আল্লাহর পথে আহ্বান করছো না। মানুষকে কেন বঞ্চিত করছো। আবদুল কাদের (রহ.) বলেন, আমি রাসূল (সা.) ও আলী (রা.)-এর আওলাদ। আমি তো আরবী জানিনা। যদি ইরাকের লোকজন তিরস্কার করেন। তাৎক্ষণিক রাসূল (সা.) বলেন, আবদুল কাদের তুমি মুখ খোল। রাসূল (সা.) কিছু একটা পড়ে ৬ বার মুখের মধ্যে ফুক দিলেন এবং রাসূল (সা.)-এর মুখের লালা আবদুল কাদের জিলানীর মুখে লাগিয়ে দিলেন। অতপর বললেন, মানুষকে হিকমত এবং উত্তম উপদেশের মাধ্যমে তোমার প্রভুর পথে পরিচালিত করো। (সূরা নাহল, আয়াত-১২৫)। এর পর থেকে হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর মাহফিলে এমন তাসির হতো যে, প্রত্যেক মাহফিলে ২/৩ জন লোক প্রভুর প্রেমে এশকে ফানা হয়ে মারা যেতো। ৫০১ হিজরীতে হযরত আবু সাঈদ মাখযুমী রহ: বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী (রহ:) কে তার মাদরাসায় ওয়াজ করার জন্য বলেন। বড়পীর রহ: সেখানে সপ্তাহে তিনদিন বয়ান পেশ করতেন। তার বয়ান এতো হৃদয়গ্রাহী ছিল যে সেখানে আমীর উমারা সহ সর্বস্তরের মানুষ সেখানে উপস্থিত হতেন। এমনকি তার বয়ান শুনার জন্য ইহুদী ও খ্রিস্টানরা ও উপস্থিত হতেন, তারা ইসলাম গ্রহণ করতেন এবং তার হাতে বায়আত হতেন। তিনি ডাকাত, বেদাতি এবং ধর্মীয় ফেতনাবাজদের সত্যের ওপর তওবা করাতেন। এরূপ লোকদের দ্বারা মজলিস পরিপূর্ণ থাকতো। তাঁর হাতে পাঁচ শতাধিক ইহুদী-খ্রিস্টান এবং লক্ষাধিক অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোক তওবা করে এবং পাপাচারির জীবন হতে ফিরে আসে। এ ছাড়া সাধারণ লোক, যারা তাঁরই বদৌলতে সৎ পথে আসার সৌভাগ্য লাভ করে, তাদের সংখ্যা বিপুল-বেশুমার। হজরত গাওসুল আজম (রহ.) এর ওয়াজ মজলিসে চারশ’ লোক দোওয়াত কলম নিয়ে উপস্থিত থাকতো এবং তার জবানী যা শ্রবণ করতো, সঙ্গে সঙ্গে তা লিপিবদ্ধ করে নিতো। একবার কোনো কারী গাওসুল আজম (রহ.)-এর মজলিসে কোরআন মজীদের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেন। হজরত আয়াতটির তফসীরে প্রথমে একটি অর্থ বয়ান করেন। অতঃপর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা, ফের তৃতীয় ব্যাখ্যা করেন, এমনকি উপস্থিত লোকদের জ্ঞান অনুযায়ী তিনি আয়াতটির এগারো রকমের ব্যাখ্যা পেশ করেন। অতঃপর সূক্ষ বিষয়গুলো বর্ণনা করেন এবং সমর্থনে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করেন, যাতে উপস্থিত শ্রোতারা অবাক ও বিস্মিত হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি আয়াতের জাহেরী ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে বাতিনী ব্যাখ্যা আরম্ভ করেন এবং বলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’, এটি উচ্চারণ করা মাত্র উপস্থিত লোকদের মধ্যে শোরগোল শুরু হয়ে যায় এবং জামা ছিড়ে অনেকে মরুভূমি বিয়াবানের দিকে ছুটতে থাকে। পীর ও মুরশিদ শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমী রহ: এর ইন্তেকাল হলে তার মাদরাসার দায়িত্ব এসে পড়ে বড়পীর রহ: এর কাছে। তিনি মাদরাসার দারস-তাদরীস ও ফতওয়ার আসন অলংকৃত করেন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট :
বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহ: সম্পর্কে ইমাম আব্দুল ওয়াহহাব শা’রানী রহ: তার আত তাবাকাতে উল্লেখ করেন বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী র. অপেক্ষা অধিক উত্তম চরিত্রবান, উদার মানসিকতা সম্পন্ন, দয়ালু, নম্র-ভদ্র, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী আমি আর কাউকে দেখিনি। উচ্চ মর্যাদা ও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছোটদের সাথে ছিলেন স্নেহপরায়ন এবং বড়দের সাথে ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তিনি সবার আগে সালাম দিতেন, দুর্বল অসহায় লোকদের সাথে উঠা বসা করতেন এবং তাদের সাথে বিনয়-নম্র ব্যবহার করতেন। তিনি নেতৃস্থানীয় কোন লোক বা শাসকশ্রেণীর কোন ব্যক্তির সম্মানের জন্য কোন দিন দাঁড়াননি এবং তাদের দরজায় কোন দিন যাননি। বড় পীর আব্দুল কাদির জিলানী (রহ:) মুস্তাজাবুদ দাওয়াত (যার দুআ সর্বদা কবুল করা হয়) ছিলেন। সব সময় চিন্তা ফিকিরে মশগুল থাকতেন। ইবাদত বন্দেগীর জন্য তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তার বয়ান শুনলে মানুষ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়তো
শয়তান ধোকা দেয়ার চেষ্টা :
একবার এক মরুপ্রান্তরে হযরত বড়পীর (রহ.) ভ্রমণ করছিলেন। ইবাদত-বন্দেগী ও ধ্যানসাধনার এক বিশেষ ক্ষণে অদৃশ্য থেকে আওয়াজ এলো! হে আবদুল কাদের আমি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট। সাধনার মাধ্যমে তুমি আজ এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছ যে, আমি আল্লাহ তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছি। অতএব, এখন থেকে শরীয়তের কোন বিধান তোমার উপর বাধ্যতামূলক নেই। তুমি ইবাদত কর বা না কর, এতে কিছু আসবে যাবে না। যে কোন ধরনের কাজে তুমি এখন থেকে স্বাধীন। এ ধরনের কথা শুনে হযরত জিলানী (রহ.) খুব দৃঢ়তার সাথে ‘লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ পড়লেন। অদৃশ্য আওয়াজটি বন্ধ হয়ে গেল। তিনি বলতে লাগলেন হে অভিশপ্ত শয়তান, তোর কুমন্ত্রণা থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি। তোর এ প্রস্তাব শুনেই আমি বুঝতে পেরেছি যে, এ তোর ভয়াবহ কৌশল। আমকে পথচ্যুত করার এক মারাত্মক কূটচাল। কেননা, পবিত্র কোরআনে আছে, আল্লাহ কোন মানব সন্তানের সাথে সরাসরি কথা বলেন না। তাছাড়া সাধনার কোন পর্যায়েই ইবাদ-বন্দেগীর দায়িত্ব কারো উপর থেকে তুলে নেয়া হয় না। শরীয়ত অমান্য করার নির্দেশ আল্লাহ কখনও কোন ব্যক্তিকে দেন না। তোর আওয়াজ শোনামাত্রই আমি বুঝতে পেরেছি যে, এমন বাণী আল্লাহর পক্ষ থেকে আসতে পারে না। এ নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল। এ কথা শুনে শয়তান বলল, এ ধরনের কথা বলে এর আগে আমি এই প্রান্তরেই অন্তত ২৭ জন সাধকের সর্বনাশ করেছি। আজ আপনি নিজ প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও উচ্চপর্যায়ের সাধনাবলেই রক্ষা পেয়ে গেলেন, হে যুগশ্রেষ্ঠ ওলী। তখন এ কথা শুনে হযরত জিলানী (রহ.) আবার পড়লেন ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’। অর্থাৎ আল্লাহর খাস রহমত ছাড়া ধূর্ত প্রতারক শয়তান থেকে বেঁচে থাকার কোন শক্তি ও ক্ষমতা আমার নেই। শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা পাওয়ারও দোয়া আল্লাহর প্রিয় নবী (সা.) আমাদের শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন। হযরত জিলানী (রহ.) এ দোয়া পড়ে বলতে লাগলেন, ঘটনার শেষ অংশে এসে তুই আমাকে নতুন করে আবার ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছিস হে বিতাড়িত শয়তান। তুই বুঝাতে চাইছিস যে, আমার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দ্বারা আমি রক্ষা পেয়েছি। অথচ আমি যে দোয়াটি পড়েছি, এতে বলা আছে ‘আল্লাহর সাহায্য ও করুনা ছাড়া রক্ষার কোন উপায় বান্দার নেই। এ মন্তব্য শুনে শয়তান বলল, সত্যিই আপনি আল্লাহর প্রকৃত খাস বান্দা। কোনভাবেই আমি আপনাকে খোদা বিমুখ করতে পারলাম না। একথা বলে শয়তান ব্যর্থ হয়ে দূরে সরে গেল।
পোশাক-পরিচ্ছেদ :
তিনি আড়ম্বরপূর্ণ উত্তম পোষাক পরিধান করতেন। কিন্তু শরীয়ত বিরুদ্ধ প্রোসাক উনি কখোনই ব্যবহার করেননি। তৎকালীন আলেমগণ যেরুপ পোশাক পরতেন তিনিও সেরা পোষাক ব্যবহার করতেন।পার্থক্য শুধু এটুকুই ছিল যে, তিনি বাজারের সর্বোচ্চ মূল্যের কাপড় ব্যবহার করতেন।
গ্রন্থ :
গাউসুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী রহ: তার তাফসীর, হাদীস, তাসাওউফ সহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক কিতাব লিখেছেন। তার প্রসিদ্ধ কয়েকটি কিতাব হলো— গুনিয়াতুত তালিবীন, ফুতুহুল গায়ব, সিররুল আসরার, তাফসীরে জিলানী, ফুতুহাতুর রাব্বানিয়্যাহ, আর রিসালাহ আল গাউসিয়্যাহ ইত্যাদি।
তিরোধান :
সারা জীবন মালিক ও মওলার আনুগত্য এবং ইবাদতে অতিবাহিত করে ।৫৬১ হিজরি ১১ রবিউস সানি তিনি (রহ.) নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে। তার সমাধিস্থল বাগদাদ, ইরাক। তাঁর স্মরণে প্রতিবছর ১১ রবিউস সানী বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছে ফাতেহা-ই-ইয়াজদহম।
উপদেশঃ
১. কারও ঘৃণা ও বিদ্বেষে এমনকি একটি রাতও ব্যয় করবেন না
২. আপনাকে অবশ্যই ঘন ঘন অনুতপ্ত হওয়া এবং ক্ষমা চাওয়া উচিত, কেননা ইহকাল ও পরকালের ব্যাপারে সফলতা অর্জনের জন্য এগুলো দুটি বড় মাধ্যম।
৩.তোমরা সর্বাগ্রে ই’লমে শরীয়ত হাসিল কর, অতঃপর নির্জনতা অবলম্বন কর।
৪.যারা আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় লাভে ব্যর্থ হয়েছে, কেবল এ ধরনের লোকেরাই আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট তাদের প্রয়োজন পূরণের প্রার্থনায় মনোনিবেশ করে থাকে।
৫.কু-সঙ্গের চেয়ে নিঃসংতা অনেক ভালো। নিজের কল্যাণের স্বার্থে এবং আযাব থেকে রেহাই পেতে যথাসম্ভব কম কথা বল।
৬.তোমার ধর্ম ও দ্বীনদারীতাকে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করো না।
৭.লৌহ যেমন আগুনে পুড়ে আগুনের রঙ ধারন করে, তেমনি আল্লাহর ওলীগন আল্লাহর নূরের তাজ্জালিয়াতে পুড়ে আল্লাহর গুনে গুণান্বিত হন।
৮.সুফি তিনিই যার নিকট জাহের এবং বাতেন পরিষ্কার।
৯.আমার আল্লাহর ইজ্জত ও মহত্বের কসম! আমার হাত আমার মুরিদ গনরেন উপর ঐ রকম প্রসারিত, যেভাবে জমীনের উপর আসমানের ছায়া।
লেখক: সম্পাদক মাসিক আলোর পথে।