আগামী (২০২০-২১) অর্থবছরের বাজেট কেমন হওয়া উচিত তা সম্পর্কে নিজেদের মতামত জানিয়েছে বিএনপি। জীবন রক্ষা ও জীবিকার বিষয় অগ্রাধিকার দিয়ে তিন বছর মেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার আলোকে বাজেট করার কথা বলছে দলটি। ১৩ দফা দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন ছয় মাসের জন্য বাজেট ঘোষণার প্রস্তাব করেছে বিএনপি।
আজ (৯ জুন) নিজ বাসা থেকে ‘বাজেট ভাবনা: অর্থবছর ২০২০-২১’ শীর্ষক ভিডিও কনফারেন্সে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম।
এ সময় তিনি করোনাকালের অভিজ্ঞতার আলোকে আগামী বাজেটে দেশের স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার উল্লেখ করে সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি দলের পক্ষ থেকে বেশকিছু পরামর্শও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিএনপি জনগণের স্বার্থে এই প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সরকার ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। আজই হয়তো তারা বিএনপির এই প্রস্তাবকে অবাস্তব–অগ্রহণযোগ্য বলবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, করোনা সংকটকালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে জোর না দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা ও জীবিকার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। করোনা সংক্রামণ রোধ করতে না পারলে কোনোভাবেই অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যখাতে এহেন ঝুঁকি থাকলে অর্থনীতির স্বস্তির কোনো অবকাশ নেই।বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা মনে করি তিন বছর মেয়াদী পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার আলোকে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে মধ্য মেয়াদি বাজেট কাঠামোয় মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির সমন্বয়ে নতুন ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে, অর্থনীতির ক্রমহ্রাসমান সংকোচন রোধে কর্মসংস্থান ধরে রাখতে হবে, আয় সংকোচন রোধ করতে হবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। গত ৪ এপ্রিল করোনা মহামারী মোকাবিলায় বিএনপির পক্ষ থেকে ৮৭ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তার যে প্যাকেজ প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো তাকে বাজেট প্রণয়নে প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় নেয়ার আহবান জানাচ্ছি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ১৩ দফা প্রস্তাবনার মধ্যে অগ্রাধিকার হিসেবে রয়েছে স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রমকল্যাণ, কৃষি, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্ধ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনর্গঠন ও স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার, সার্বজনীন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গঠন, সরকারি বিনিয়োগ ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রম কল্যাণ, কৃষি, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতের বরাদ্ধ বৃদ্ধি, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কৃষি ও গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, কর্মহীন, কর্মক্ষম, বেকার, দরিদ্র মানুষদের নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান প্রভৃতি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠি বিশেষ করে ‘দিন আনে দিন খায়’ শ্রেণির মানুষজনদের সার্বজনীন সামাজিক কর্মসূচির আওতায় এনে তাদের নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান, বেকার ভাতা-প্রতিবন্ধী ভাতা-শিশু প্রতিপালন ভাতা-পেনশন ভাতা-আবাসন সুবিধা, স্বাস্থ্য ভাতা প্রদানে এই খাতে জিডিপির ৬-৭ শতাংশ বরাদ্ধ, আইটি প্রযুক্তি ও গবেষণা খাতে বিশেষ বরাদ্ধ, কৃষি ও খাদ্য খাতে জিডিপি ও বাজেটের কমপক্ষে ১ দশমিক ৫ ও ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ বরাদ্ধ, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবাখাতে বরাদ্ধ জিডিপির দশমিক ৭৩ শতাংশ ও বাজেটের ২ দশমিক ৮১ শতাংশ বৃদ্ধি, সবুজ শিল্পায়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতি উজ্জীবন, সমন্বিত শিল্পায়ন ও অবহেলা উন্নয়নের ইকুইটি ম্যাচিং তহবিল ও কৃষি কমিশন গঠন, প্রবাসীদের সহজশর্তে ঋণ প্রদান, সুপারিশও করা হয়েছে বিএনপির এই প্রস্তাবনায়। মহামারী পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস, বিদ্যুতখাতে ক্যাপাসিটি চার্জ ভর্তুকি বাদ দেয়া, অতিরিক্ত জনবলের বিষয়ে ব্যবস্থাগ্রহণ, দ্বি-পক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উৎস থেকে বিদেশী অনুদান বৃদ্ধি, দীর্ঘমেয়াদি কম সুদের ও গ্রেস পিরিয়ড সম্পন্ন বিদেশী ঋণ নেয়া, অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ না দেয়া ট্রেজারি বিল ও সঞ্চয়পত্রের ঋণ পরিশোধ ব্যয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার আমদানি তহবিল গঠন, সহজে কর আদায়ের খাতসমূহ এক্সপ্লোর করা, দেশে অবস্থানরত কর্মরত অনিবন্ধিত প্রায় আড়াই লাখ বিদেশী নাগরিকদের কাছ থেকে ওয়ার্ক পারমিট ও আয়কর বাবদ প্রায় দেড় মিলিয়ন অর্থ আদায় করা, ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল সক্রিয় করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো থেকে কর বৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা অদলবদল বা কারেন্সি সোয়াপ, বার্টার ব্যবস্থা চালুর পদক্ষেপ গ্রহণ, পুঁজিবাজার বর্হিগমন নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতি কঠোরভাবে মনিটরিং করার মাধ্যমে বাজেটে অর্থসংকুলানের ব্যবস্থা করার সুপারিশও করা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবনায়।
তিনি বলেন, পত্রপত্রিকা সূত্রে জানা যায়, বাজেটের আকার হতে পারে পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেট পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল ৮.২ শতাংশ। সংশোধিত হার ৫ শতাংশ নির্ধারণের কথা শোনা যায়। যদিও আইএমএফ বলছে চলতি অর্থবছরে জিডিপি হবে ৩.৮ শতাংশ, বিশ্বব্যাংক বলছে ২-৩ শতাংশ এবং ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স বলছে ১.৬ শতাংশ হবে। আসন্ন বাজেটে জিডিপির ছয় শতাংশ ঘাটতির প্রস্তাব করা হচ্ছে। ঘাটতির পরিমাণ হতে পারে এক লাখ ৭২ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা; যা চলতি বছর ছিল তিন লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সাত হাজার কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে এনবিআর সূত্রে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি, আর বাকি ৫৯ হাজার কোটি অন্যান্য খাত হতে আসবে। এনবিআর এর পক্ষে এত বিরাট অঙ্কের রাজস্ব আহরণ (প্রায় ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি) একেবারেই অসম্ভব। তাই এবারের বাজেট হতে যাচ্ছে কাল্পনিক কাগুজে বাজেট। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনাকালের এবারের বাজেট গতানুগতিক হবে না। এবার করতে হবে বিশেষ বাজেট। লক্ষ্য হওয়া উচিত আগামী ছয় মাসের জন্য একটা অন্তর্র্বতীকালীন বাজেট করা।
সি-তাজ২৪.কম/এস.টি