ভাষা সৈনিক, প্রচার বিমুখ প্রয়াত সাংবাদিক, সমাজসেবক ছৈয়দ মোস্তফা জামাল ২০০৪ সালের ২২ এপ্রিল আমাদের শোক সাগরে ভাসিয়ে চিরতরে চলে গেলেন। আমি তাহার ১৭তম মৃত্যু বার্ষিকীতে রূহের মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসিব করুন। ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সাবেক কর্মকতা ও পটিয়া উপজেলার শোভন দন্ডীর প্রয়াত শিক্ষাবিদ ও কবি ওয়ালি মিঞা মাষ্টার ’চট্টগ্রাম সমিতি ও সৈয়দ মোস্তফা জামালকে’ নিয়ে কবিতা লিখেছেন –
“ছৈয়দ মোস্তফা জামাল খাটেন বহুতর,
সমিতির কাজে তিনি যান ঘরে ঘর।
সেক্রেটারীর গুরুভার তিনি বহন করে,
দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি চার বৎসর ধরে।
সমাজকর্মী ছৈয়দ ছোলতান, জামাল তাঁর ছেলে
বসতি দেখবেন আছে মির্জাখীলে গেলে,
প্রাথমিক শিকদের খেদমত করিয়া
সত্তর বছর বয়স তাঁর গেল কাটিয়া।
জনাব ছোলতানের ছিল পর হিতে মন,
তাইত জামাল পিতারমত সমাজকর্মী হন ॥”
সৈয়দ মোস্তফা জামালের পেশা সাংবাদিকতা হলেও এ পেশাকে পরিপূর্ণভাবে আর্তমানবতার সেবায় তিনি কাজে লাগান। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সমাজ সেবার জন্য যুগ যুগ ধরে সৈয়দ মোস্তফা জামাল মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকবেন। সৎ সাংবাদিকতা ও নিষ্ঠার সাথে সমাজসেবার কারণে আর্থিক টানা পোড়নের জন্য তিনি কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে যেতে পারেননি। সৎ মানুষের জন্য যথাসাধ্য কল্যাণ করার আজীবন চেষ্টা করেছেন। তিনি বলতেন, ‘‘বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের সমস্যাদি চিহ্নিত, তাদের বক্তব্য সংবাদপত্রের মাধ্যমে সমাজে তুলে ধরা সম্ভব হলে মহান আল্লাহর নিকট সওয়াব ও রহমত পাওয়া যায়।’’
প্রকৃতপে সাংবাদিকতা একটি মহৎ ও সম্মানী পেশা। যার আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সমস্ত প্রাণীকুলের সমস্যাদি চিহ্নিতকরণ এবং সমাধানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা। দেশ ও জাতির প্রতি কর্তব্য পরায়নতা, রাজনৈতিক পরিমন্ডলে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে কর্তব্যের প্রতি সচেতন রাখার জন্য, রবুরিয়ত কায়েম, সর্বোপরি স্বীয় পিতার আদর্শ অনুকরণে জাতীয় রাজনীতির সাথেও সৈয়দ মোস্তফা জামাল সংশ্লিষ্ট ছিলেন। মাওলানা ভাসানীর পথ ধর, রবুবিয়ত কায়েম করার শ্লোগানে উজ্জীবিত ছিলেন আজীবন। তিনি ন্যাপ(ভাসানীর)বিভিন্ন পদে দীর্ঘ সময় সক্রিয় দায়িত্ব পালন করেন।
ছৈয়দ মোস্তফা জামাল আত্মজীবনী লিখেন ১৯৯৭ সালে। ভূমিকায় লিখা ছিলেন নিম্মরূপঃ “সকল প্রশংসা আল্লাহ্তালার। লাখ লাখ দরুদ ও সালম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) এর প্রতি। আল্লাহরসকলের গুনাহ্ মাফ করুন এবং আমরা যেন প্রত্যেকে প্রত্যেকের হক আদায় করি এবং মাফ করে দেয়ার তওফিক দিন। আমিন”। তার পূর্ব পুরুষ সৌদি আরব,ইরাক, তুরস্ক,আফগানিস্তান হয়ে দিল্লী ও ঢাকায় বসবাস করতেন। দিল্লীর বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরের আমলে চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া গ্রামে হযরত কাতাল পীর শাহ্ (রঃ) এর প্রতিষ্ঠিত মসজিদ, মাদ্রাসা ও সমাজ কল্যাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে জনসেবার জন্য তাঁর পূর্ব পুরুষ লাখরাজ সম্পত্তি লাভ করেন।
সাংবাদিক ও সমাজসেবক সৈয়দ মোস্তফা জামাল জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৪ সালের ৮ ই জানুয়ারী সোমবার পবিত্র রমজান মাসে। তার দাদা ছৈয়দ আলিম উল্লাহ্ শাহ্ ভারতীয় উপমহাদেশ ও আরাকানে ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি খেলাফত আন্দোলনের একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন এবং বিখ্যাত ছৈয়দ আহমদ বেরেলভীর অনুসারীদের সাথে পবিত্র হজ্ব আদায় করেন।
তাঁর বাবা ছিলেন কোলকাতাস্থ নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক সমিতির প্রথম সাধারণ সম্পাদক ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের কারাবরণকারী নেতা মরহুম আলহাজ্ব মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ।
১৯৫১ সালে সৈয়দ মোস্তফা জামাল তমদ্দুন মজলিশের বৃহত্তম সাতকানিয়া থানার সাধারণ সম্পাদক নিবার্চিত হন। এ বৎসর সাতকানিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্র মিলনায়তন সম্পাদক পদেও তিনি নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে ঢাকার ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক এর সাতকানিয়া প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন।
১৯৫২ সালে বৃহত্তর সাতকানিয়া থানার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আন্দোলনের আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ঐ সময় ব্যাপক মিছিল সভা, অবরোধ কর্মসূচী পালন এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা এর পে সক্রিয় প্রচার চালান। সাতকানিয়ার আহবায়ক হিসেবে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও এপ্রিল মাসে ঢাকায় ভাষা সম্মেলনে অংশ নেন। ঐ সময় তখনকার সদস্য কারামুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে চট্টগ্রামসহ ভাষা আন্দোলন বিষয়ে মত বিনিময় করেন। এই সালে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক চট্টগ্রামে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক সম্মেলন উদ্বোধন করেন। সম্মেলনের সংগঠক পিতা মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদের সাথে তিনি সর্বন কাজ করেন।
সৈয়দ মোস্তফা জামাল ১৯৫৪ সালে জেলা যুক্ত ফ্রন্ট কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। প্রচার সম্পাদক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক ডঃ মাহফুজুল হক। মরহুম ডঃ মাহফুজুল হকের নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালে শেরে বাংলার সাথে সাাৎ করে চট্টগ্রাম থেকে একজন মন্ত্রী নিতে অনুরোধ করেন। ১৯৫২ সালে দৈনিক আজান, ১৯৫৩ সালে দৈনিক সংবাদ, ১৯৫৪ সালে ঢাকায় দৈনিক মিল্লাত ও সপ্তাহিক সৈনিক এ সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৮ সালে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক নাজাত, ১৯৫৯ সালে দৈনিক ইত্তেহাদ,দৈনিক পয়গামের সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২ সালে দৈনিক স্বদেশ এর বার্তা সম্পাদক ও বার্তা সংস্থা সি.পি. আই ও দৈনিক ইত্তেফাকে
কাজ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তান কিশোর মজলিশ গঠন করেন। মওলানা মোহাম্মদ বজলুল রহিম, শিল্পী হাসান রেজা, ডাঃ ফখরুল ইসলাম চৌধুরী, ব্যাংকার এ.কে.এম মহিউদ্দিন খোকন ঐকমিটির সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৬০ সালে দৈনিক আজাদীর ঢাকা ব্যুরো প্রধান নিযুক্ত হন। এ সময় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সংবাদদাতা ইউনিটের উপ প্রধান ছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের রাওয়াল পিন্ডিতে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খাঁনের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং পাক-ভারতের বিরোধপূর্ণ এলাকা মারি, মোজাফ্ফারাবাদ ও কাশ্মীর সফর করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের লাহোরে সমাজ সেবা সম্মেলনে অংশ নেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ৪ দফায় ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সাধারন সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ থাকায় তিনি প্রথমে রংপুরের বুড়িমারি সীমান্তপথে ভারতের দক্ষিণ ২৪পরগণা জেলা,কোলকাতা এবং মেঘালয় রাজ্যে এবং আগরতলায় অবস্থান করেন।
সৈয়দ মোস্তফা জামাল ছিলেন নিরহংকার ও নিবেদিতপ্রাণ বিরল সমাজসেবী, জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। ঢাকাস্থ যক্ষ্মা সমিতিরও কার্যকারী কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে সাতকানিয়া কচি কাঁচার মেলা গঠন করেন। ৭৪ সালে এর সম্মেলন হয়। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বতারায় যোগ দেন।
১৯৮০ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহকারী মহাসচিব নির্বাচিত হন। এ সময় মাওলানা ইসলামাবাদী একাডেমী গঠিত হলে ব্যারিষ্টার বজলুস সাত্তার সভাপতি, মোস্তফা জামাল সাধারণ সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম সাংবাদিক হাউজিং সোসাইটির উদ্যোক্তা পরিচালক নির্বাচিত হন।
তিনি চট্টগ্রাম প্রেস কাব ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে)’র সদস্য, দৈনিক পূর্বতারার সাবেক বার্তা সম্পাদক ছিলেন। তিনি সাতকানিয়া সাহিত্য বিশারদ কচি কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। বাংলাদেশ সীরাত মিশন চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি,বিচারপতি আমীরুল কবির চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমাজ কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি। ১৯৬০ সাল থেকে জাতীয় প্রেসকাবের সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকার বাংলা কলেজের গভর্নিং বড়ির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। কবি কায়কোবাদ সাহিত্য মজলিশের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আলেমা খাতুন ভাসানীর নেতৃত্বধীন ন্যাপ ভাসানীর সাবেক কেন্দ্রীয় শিা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় ঈদ জামাত কমিটির সাবেক প্রচার সম্পাদক, প্রাচীণ সমাজ উন্নয়ন সঙগঠন বাংলাদেশ সমাজ কল্যাণ সমিতি(বিএসকেএস)র সহ-সভাপতি,সাধারণ সম্পাদক, চকবাজার আজিজুর রহমান জনকল্যাণ পরিষদ, সমাজ কল্যাণ ত্রাণ কমিটি, অপরাধী সংশোধন সংস্থা, আলহাজ্ব নুর মোহাম্মদ সওদাগর আলকাদেরী (রঃ) স্মৃতি সংসদের সদস্য, ডঃ মাহফুজুল হক স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, কবি আলাদীন আলীনুর সাহিত্য সংসদের সম্পাদক, বাংলাদেশ দ্বীনি একাডেমী এবং খোলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়াত সদস্য ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি মাওলানা মনিরুজ্জান ইসলামাবদী গবেষণা একাডেমীর সভাপতি ছিলেন। তিনি শাহ মোহাম্মদ বদিউল আলম, মঘীস্থানে (দণি চট্টগ্রাম) ইসলাম প্রচার, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও ডক্টর এম মাহফুজূল হক পুস্তকের লেখক। তিনি ২০০১ সালে শেরে বাংলা জাতীয় পুরষ্কার লাভ করেন। একই সালে ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি, সমিতিতে অসমান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সমিতির সম্মাননা পদক লাভ করেন।
সাংবাদিকতায় কৃতিত্ব পূর্ণ অবদানের জন্য ২০০১ সালে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি তাঁকে স্বর্ণ পদকে ভুষিত করেন, ২০১০ সালে মরনত্তোর সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমদ পদক পান। তিনি ১৯৯১ সালে ন্যাপ ভাসানীর পে চট্টগ্রাম মহানগর (চট্ট- ৯), ১৯৯৬ সালে চন্দনাইশ ও ২০০১ সালে সাতকানিয়া- লোহাগাড়া আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সাংবাদিকতা জীবনে তিনি অসংখ্যবার প্রেস ইনষ্টিটিউটের প্রশিণে অংশগ্রহণ করেন। প্রবীণ বয়সেও প্রশিণে অংশ নিতে দ্বিধা করতেন না। ২০০৩ সালের প্রথম দিনে উচ্চরক্ত চাপ, জ্বর, ডায়াবেটিস, প্রষ্টেট গ্লাান্ডের আকৃতি বড় হওয়া ইত্যাদি রোগের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হন। দীর্ঘ আড়াই মাস হাসপাতালে কাটিয়ে বাসায় ফিরলেও প্রচন্ড শারীরিক দুর্বলতার কারণে শয্যাশায়ী থেকে যান। তখন আর সভা-সমাবেশে যেতে পারেন নি। টানা ১ বছর ১ মাস ১১ দিন চট্টগ্রাম শহরের পাঠানটুলীস্থ বাসভবনে চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি ২২ এপ্রিল ২০০৪ বৃহস্পতিবার রাত ৮ টা ৫ মিনিটে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন।
আজকের এইদিনে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এই পার্থনা করি তাকে বেহেস্ত দান করেন।আমিন।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।
সি-তাজ২৪.কম/এস.টি