স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে সব ভেদাভেদ ভুলে সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘আসুন, সকল ভেদাভেদ ভুলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলি।’
বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এই আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের এই অর্জন এ দেশের সাধারণ মানুষের। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক-পেশাজীবী, আমাদের প্রবাসী ভাইবোনেরা, এ দেশের উদ্যোক্তা— তাদের শ্রম, মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে দারিদ্র্য নিরাময়ের অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে তুলেছেন। আমার সরকার শুধু নীতি সহায়তা দিয়ে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। আপনারা প্রমাণ করেছেন, বাংলাদেশের মানুষ অনুকূল পরিবেশ পেলে যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে।
সরকারের গত ১২ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আর্থসামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত মাসে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। গড় আয়ু, লিঙ্গ সমতা, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, নারী শিক্ষা, নারীর রাজনৈতিক অধিকার, নারী ও শিশু মৃত্যুহার, স্যানিটেশন, খাদ্য প্রাপ্যতা ইত্যাদি নানা সূচকে বাংলাদেশ শুধু তার প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে এগিয়েই যায়নি, অনেক ক্ষেত্রে অনেক উন্নত দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে।
‘আজকের এই উত্তরণের পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। দেশের ভেতরে-বাইরে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে নানা অপতৎপরতা চালিয়েছে। সে প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত আছে,’— বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই সবাইকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশবিরোধী সব অপতৎপরতা রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা। প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে ছাত্রছাত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে, শ্রমিক কারখানা ছেড়ে, কৃষক লাঙল ফেলে, কামার, কুমার, জেলে তাদের কাজ ফেলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে প্রতিরোধ সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন।
শেখ মুজিব একটি দেশ, একটি জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা :
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নামের সেই মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। তার জন্ম হয়েছিল বলেই আজ আমরা নিজস্ব দেশ, ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে গর্ববোধ করি। শেখ মুজিব একটি দেশ, একটি জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা। কাজেই তার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা একযোগে উদযাপন করছি।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির জনকের ভূমিকা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ২৪ বছরের নিরন্তর রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। আর এই সংগ্রামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর এই সংগ্রাম ভাষার অধিকারের দাবিতেই শুরু হয়েছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সৃষ্ট আন্দোলনে যে স্বাধিকারের বীজ বপন করেছিলেন, তাকেই সযত্নে লালন-পালন করে তিনি স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পরিণত মহিরূহে রূপান্তরিত করেন। শেখ মুজিব থেকে পরিণত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবে।
তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ঐতিহাসিক ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পাই স্বাধীনতা।
জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। একবার ভাবুন, আমরা আজ যে স্বাধীন দেশের মাটিতে আজ মুক্ত নিঃশ্বাস ফেলছি, তা অর্জনে কত শত তরুণ অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন? কত মা তাদের সন্তান হারিয়েছেন, কত বাবা তাদের পুত্র হারিয়েছেন, কত ভাইবোন তাদের ভাই হারিয়েছেন, কত স্ত্রী তাদের স্বামী হারিয়েছেন, সন্তানেরা বাবা হারিয়েছেন? কত শত মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গু হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন?
শেখ হাসিনা বলেন, তাদের একটাই প্রত্যাশা ছিল— এ দেশ স্বাধীন হবে। এ দেশের মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। সবাই মৌলিক অধিকার ভোগ করবে। আজ আমরা তাদের সেই প্রত্যাশা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পেরেছি।
‘সুবর্ণজয়ন্তীর এই শুভক্ষণে আমাদের শপথ নিতে হবে কেউ যেন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। দেশের গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে না পারে,‘— বলেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্য দেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানান দলটির সভাপতি সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানাই এজন্য যে জাতীয় জীবনের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক উদযাপনের সময় স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়েছেন।
ভাষণের শেষে শেখ হাসিনা বলেন, ”এবারের স্বাধীনতা দিবস অন্যান্য বছরের স্বাধীনতা দিবসের মতো নয়। এবার স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হলো। এই দিন আনন্দে অবগাহনের দিন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় তাই আহ্বান জানাই: আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে/ কে আছ জাগিয়া পূরবে চাহিয়া/ বলে ‘ওঠ ওঠ’ সঘনে গভীর নিদ্রামগনে।/হেরো তিমির রজনী যায় ওই, হাসে ঊষা নব জোতির্ময়ী-/নব আনন্দে, নব জীবনে,/ফুল্ল কুসুমে, মধুর পবনে, বিহগ কলকূজনে।”
সি-তাজ২৪.কম/এস.টি