মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের
বাঁঁশখালীঃ-
ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় হতাশা নিয়ে লবণ চাষ শুরু করেছেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাষীরা। জমিতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি জমিয়ে তাতে সূর্যের তাপ দিয়ে পানি শুকিয়ে তৈরি হয় লবণ। এ উপজেলার বঙ্গোপসাগরে উপকূল বেষ্টিত বিভিন্ন ইউনিয়নে লবন উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। সবেমাত্র ওই জায়গায় চিংড়ি-ঘের গুটিয়ে লবন মাঠ তৈরি করে লবন উৎপাদন করছেন তারা। লবন চাষে সাফল্যকে পুঁজি করে এ বছর ও চাষিরা পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছেন। বিগত অর্থ বছর গুলোতে লবণের ব্যাপকহারে দাম পাওয়ায় চাষীরা এবার ও লবণ উৎপাদন করতে উৎসাহ বেড়ে গেছে। ফলে চাষীরা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে লবণমাঠ তৈরীর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মজুদকৃত লবণ বিক্রির পাশাপাশি লবন মাঠ তৈরীরও ধুম পড়েছে। বিগত দিনের মজুদকৃত লবণগুলো ৫-৬ টাকা কেজির লবণ এখন খুচরা বাজারে ১০-১৫ টাকার উপরে। বিগত বছর গুলোতে প্রতি বৎসর জন্য প্রতি কানি (৪০ শতক) জমি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় লাগিয়ত নিই। প্রতি কানিতে চাষাবাদে খরচ পড়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। এতে লাভ হয় খরচের দ্বিগুণ। তবে বর্তমানে প্রতিকানি জমিতে লাগিয়ত ২০ হাজার টাকা,প্যালিথিন ৫ হাজার টাকা,পানি সেচ ৪ হাজার ও মজুরী ৩০ হাজার টাকা। খরচ পড়ে প্রায় প্রতিকানিতে ৬০ হাজার টাকা। লবন উৎপাদন হয় প্রতিকানিতে তিন শত মন। কিন্তু দাম নিয়ে হতাশায় চাষিরা। কারণ, প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে ২০০ টাকার বেশি খরচ হলেও চাষিরা ১৮০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে খরচ এবং লভাংশ্য প্রায় সেইম। যার কারনে বর্তমানে চাষীরা নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভাল দাম না পাওয়ায় লবণ চাষীরা এখন খুবই হতাশ । তবু ও চাষীদের মজুদকৃত লবণ বিক্রির ধুম পড়েছে সর্বত্র। বর্তমানে লবণ চাষীরা প্রতিমণ লবণ ২শ থেকে সাড়ে ২৫০ টাকায় বিক্রি করছে। দেশের কক্সবাজার এবং খুলনার পর চট্টগ্রামের একমাত্র বাঁশখালীতেই লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে। বাঁশখালীতে ছনুয়া, সেখেরখীল,গন্ডামারা, সরল, পশ্চিম মনকিচর, কাথরিয়া, খানখানাবাদ, প্ুঁইছুড়ি (আংশিক) এলাকার লবণ উৎপাদন হয়। চাষীরা মোটামুটি পর্যায়ে লবণের দাম পেলেও এবং চাহিদা কম থাকায় বেশ কিছু লবণ ব্যবসায়ী লবণ মজুদ করে রাখে। সম্প্রতি সময়ে এই লবণের দাম তেমন বৃদ্ধি না হলেও চাষীরা মজুদকৃত লবণ বিক্রির করার ধুম পড়ে গেছে তাদের মাঝে।
সরেজমিনে গতকাল বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) উপজেলার গন্ডামারা, ছনুয়া, সরল, সেখেরখীল ইউনিয়নের এলাকা পরির্দশন কালে চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই তিন ইউনিয়ের প্রায় হাজার হাজার একর মাঠজুড়ে লবন উৎপাদনের লক্ষ্যে মাঠ চাষে ব্যস্ত অর্ধশতাধিক চাষি পরিবার। সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা অবদি যেন চাষিদের অন্য কোনো কাজ করার সময় নেই। তবে আবহাওয়া অনুকুল থাকায় চলতি উৎপাদন মৌসুমে প্রচুর পরিমান লবন উৎপাদন হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে মজুদ রয়েছে বিপুল পরিমান লবন। তবে এবার লবণের মূল্য কম থাকায় চাষীদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। ডিসেম্বর মাস থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হয়ে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত লবণ উৎপাদন অব্যাহত থাকবে। উপকূলের অধিকাংশ মানুষ লবন চাষে আগ্রহ থাকলে ও নায্য মূল্য না পাওয়ায় তারা হতাশা ভোগ করেছেন বলে জানা যায়। এই উপজেলাতে দুই ধরনের পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হয়। বর্তমানে সরকার লবণচাষীদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ করে দেয়ায় চাষীরা তাদের পূর্ণ শ্রম এখন লবণ মাঠে দিয়ে যাচ্ছেন। বাঁশখালীতে উৎপাদিত লবণ বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সারাদেশে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকায় নিজস্ব তদারকির মাধ্যমে লবণ উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকে।
এ ব্যাপারে সরল এলাকার লবণ ব্যবসায়ী আনছুর আলী জানান, লবন চাষের জন্য প্রথমে জমিকে ছোট ছোট ভাগ করে নেয়া হয়। এরপর ভেজা মাটিকে রোলার দিয়ে সমান করে বিছিয়ে দেয়া হয় মোটা পলিথিন। জোয়ার আসলেই মাঠের মাঝখানে তৈরি করা গর্তে জমানো হয় সাগরের লবন পানি। বালতি ভরে বিছানো পলিথিনের উপর রাখা হয় পানি। জলীয়বাষ্প হয়ে উড়ে যায় পানি আর মাঠে জমে যায় লবনের আস্তরণ। সেই লবন তুলে স্তপ করে রাখা হয় যেন সরে যায় পানি। পূর্বের চেয়ে লবণের দাম ১৮০ থেকে ২শ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। দাম বৃদ্ধি না হলেও চাষীরা তাদের মজুদকৃত লবণ বিক্রি করছে। সামনে এই দাম স্থায়ী নাও পেতে পারে আবার হতে ও পারে, তবু ও এই আশংকায় চাষীরা তাদের মজুদকৃত লবণ তড়িগড়ি করে বিক্রি করে দিচ্ছে।
ছনুয়া খুদুকখালী এলাকার লবন চাষী রেজাউল করিম জানান,আমি প্রতিবছর ১২ খানি জমিতে লবন চাষ করি। প্রতিখানি জমিতে ৫ হাজার টাকার প্যালিথিন,পানি সেচ ৪ হাজার,মজুরী ৩০ হাজার ও জমির লাগিয়ত ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতিখানীতে খরচ হয় ৬০ হাজার টাকা। লবন উৎপাদন হয় খানিতে ৩ শ মণ। আমরা প্রতি মণ বিক্রি করি মাত্র ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। খরচ আর উৎপাদনে তেমন কোন লাভংশ হয় না। গতবছর ১২ খানি জমিতে ৪ লক্ষ টাকা লোকসান ছিল। বিদেশি লবণের কারণে স্থানীয় চাষিরা লবণের দাম পাচ্ছেন না। বর্তমানে লোকসানের কারণে বহু চাষি লবণ উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
সরল এলাকার লবণচাষী ইয়াছিন, মোজাফ্ফর, আরিফ, খালেদ জানান, লবণের চাষ এবারো প্রতিবছরের ন্যায় খুব ভাল হবে বলে আশা করি। সরকার যদি বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকায় উৎপাদিত এসব লবণ দেশের সর্বত্র রপ্তানিতে সহযোগিতা করেন তাহলে এখানকার লবণ চাষীরা আরো বেশী উপকৃত হবে। তারা এই লবণ শিল্প রক্ষা এবং মানসম্মত লবণ উৎপাদনে সরকারকে আরো বেশী মনযোগী হওয়ার আহবান জানান।
বাঁশখালীর গন্ডামারা এলাকার বিশিষ্ট লবণ ব্যবসায়ী আবু আহমদ বলেন, বাঁশখালীতে যে লবণ উৎপাদন হয় তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হলে দেশের চাহিদা পূরণ করে বাইরেও রফতানি করতে পারবে। কিন্তু কতিপয় ব্যবসায়ী ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির জন্য বাইরে থেকে লবণ আমদানি করে দেশে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে। বর্তমান সরকার তা কঠোরহস্তে দমন করায় বাঁশখালীতে বর্তমানে অর্ধলক্ষাধিক লবণচাষী ন্যায্যমূল্য ও পরিশ্রমের যথাযথ মূল্য পাবেন এ আশায় লবরেণ মাঠে রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
ছনুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ বলেন, এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ লবন চাষ করে থাকে । যুগ যুগ ধরে এই ইউনিয়ের অধিকাংশ মানুষ কম খরচে লাভ বেশি তাই লবন চাষ করে থাকেন। এই ইউনিয়ন টি লবণ শিল্প বল্লেই চলে। বর্তমানে আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ লবণচাষী ন্যায্যমূল্য ও পরিশ্রমের যথাযথ মূল্য পাবেন এ আশায় লবরেণ মাঠে রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।